বিশ্ব উষ্ণায়ন, যার ফলে এ ভাবে পাল্টে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া।
২০০৮ সালের মার্চে মাসে এই দেশে আসি। এখানে আসার আগে কোনও দিন ভাবিনি যে, এখানেও কলকাতার মতো গরম পাব!
২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেই লোকে এখানে বলতে শুরু করে এ হচ্ছে ‘ইন্ডিয়ান সামার’। প্রথম প্রথম শুনে হাসতাম। ভাবতাম, সত্যি যদি ‘ইন্ডিয়ান সামার’ হয় এরা তখন কী করবে! এখন কিন্তু ক্রমশ এটাই সত্যি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ বছর এখানে জুলাই মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। লন্ডনে যে এত গরম পড়বে, তা অনেকেই ভাবতে পারেননি।
এখানকার কোনও কিছুই এই গরমের মোকাবিলা করার জন্য তৈরি নয়। অধিকাংশ বাড়িতেই ‘ডাবল গ্লেজ়ড’ কাচ লাগানো জানলা, যা ঠান্ডায় ঘর গরম রাখতে সাহায্য করে। এই গরমে সেটাই আরও কষ্টকর হয়ে ওঠে। জানলায় লাগানো বড় কাচ, যা আবার পুরোটা খোলাও যায় না। বেশির ভাগ ঘরের মেঝেতেই রয়েছে কার্পেট। তাতে ঘর আরও গরম হয়ে যায়। এসি তো দূরের কথা, বেশির ভাগ বাড়িতে পাখাও নেই। তখন মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় কলকাতার গরমের কথা। লোডশেডিংয়ে ঘরে বসে রয়েছি। সঙ্গী হাতপাখা। এ দেশের পরিকাঠামো তৈরি ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য, গরম থেকে নয়। সেই কারণে সব কিছুই যেন থেমে যায় এই গরমে। অফিস, কাছারি, স্কুল, যানবাহন... সবই যেন থতমত খেয়ে যায়। অফিসে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নেই। তবে অনেকে পাখার ব্যবস্থা করেন। আবার অনেক অফিসে কর্মীদের ঠান্ডা রাখার জন্য আইসক্রিম খাওয়ানোও হয়। অনেকেই অফিস ছুটির পরে লেকে নেমে পড়ে শরীর জুড়োন। শরীর ঠান্ডা রাখার জন্য হাল্কা খাবার, ফল, ফলের রস, দই, স্যালাড ইত্যাদি খান। অনেকে আবার ঘর ঠান্ডা করার জন্য ছোট ছোট তোয়ালে ভিজিয়ে পাখার সামনে রেখে দেন। ঠান্ডা থাকার জন্য অনেককে আইসপ্যাক ব্যবহার করতেও দেখেছি।
গরমে ইউরোপ
• জুলাইয়ে প্যারিস ছুঁয়েছে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এ পর্যন্ত ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে ফ্রান্সে।
• ব্রিটেনে পারদ ছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
• বেলজিয়ামে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছুঁয়েছিল
৪১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
• লুক্সেমবার্গে ৩৯ ডিগ্রি সেলিসিয়াস উঠেছিল।
• নেদারল্যান্ডসে ছিল ৪০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
• জার্মানিতে সর্বোচ্চ ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল।
প্রভাব
• গবেষকরা বলছেন, হারিকেন বা বন্যার মতো ক্ষয়ক্ষতি চোখে পড়ে না তাপপ্রবাহে। হিট-স্ট্রোকে সামান্য লোকই মারা যান। কিন্তু বড় ক্ষতি হয় ধীরে ধীরে। ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রে রোগ বাসা বাধে। ২০০৩ সালে তাপপ্রবাহের জেরে গোটা ইউরোপে অন্তত ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
গত ২৫ জুলাই ছিল এ বছরের উষ্ণতম দিন। স্কুলে ছুটি পড়ে যাওয়ায় আমাদের বাড়ি থেকে বেরোতে হয়নি। কিন্তু সে দিন এতটাই গরম ছিল যে, বাড়ির ভিতরে বেশি গরম, না বাইরে, তা-ও যেন বুঝতে পারছিলাম না। সারা দিন ঘর ঠান্ডা রাখার জন্য নানা রকম চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। কখনও জানলা বন্ধ করে পর্দা টেনে দিয়েছি আবার কখনও বা জানলা খুলে দিয়েছি এই ভেবে যে, একটু হাওয়া ঢুকলে গরমটা কেটে যাবে। এই ভাবেই সারাটা দিন কাটল। রাত ন’টা নাগাদ সূর্যাস্ত হওয়ার পরে একটু যেন স্বস্তি পেলাম।
খুব গরম পড়লে রাতেও ঠিক মতো ঘুমোনো যায় না। অনেক সময়ে একাধিক পাখারও দরকার পড়ে। কারণ এখানে সিলিং ফ্যানের কোনও ব্যবস্থা নেই। সবই পেডেস্টাল বা ডেস্ক ফ্যান। এ ভাবে গরম বেড়ে চললে এ দেশেও হয় তো পাখা বা এসি ব্যবহারের চলন বেড়ে উঠবে।
কিন্তু সে তো সাময়িক স্বস্তি। আসল চিন্তার কথা হল, বিশ্ব উষ্ণায়ন, যার ফলে এ ভাবে পাল্টে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া। আমরা সবাই যদি এখনই একজোট হয়ে কিছু না-করি, তা হলে আমাদের পরের প্রজন্মের জন্য সুস্থ একটা পৃথিবী আর রেখে যেতে পারব না।