Rabindranath Tagore

বিশ্ব-সাথে যোগে... রবীন্দ্রগীতের মূর্ছনায় আপ্লুত ফরাসি শ্রোতারা

ঘরভর্তি ফরাসি শ্রোতার কাছে পেশ করা হল, মূল বাংলা-সহ ফরাসিভাষায় অনূদিত ১৫টি রবীন্দ্রসঙ্গীত। অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, কী করে সম্ভব হল এই অনুষ্ঠান? ফরাসিদের কেমন লাগল রবীন্দ্রনাথের গান?

Advertisement

শ্রেয়স সরকার

লিয়ন শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:৫২
Share:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। —ফাইল চিত্র।

গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে— বলেছিলেন কবি। কিন্তু সত্যিই কি সব বন্ধন ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সঙ্গীত? উত্তর পেলাম সম্প্রতি, ফ্রান্সের লিয়ন শহরের এক অনুষ্ঠানে। ঘরভর্তি ফরাসি শ্রোতার কাছে পেশ করা হল, মূল বাংলা-সহ ফরাসিভাষায় অনূদিত ১৫টি রবীন্দ্রসঙ্গীত। অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, কী করে সম্ভব হল এই অনুষ্ঠান? ফরাসিদের কেমন লাগল রবীন্দ্রনাথের গান? বলছি।

Advertisement

আট-ন’মাস হয়ে গেল পূর্ব ফ্রান্সের এই লিয়ন শহরে। এরই মধ্যে পরিচয় হয়েছে শহরের একাধিক গুণী সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে, যাঁদের মধ্যে অনেকের প্রশিক্ষণ লিয়নে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত ন্যাশনাল হাই কনজ়ারভেটরি অব মিউজ়িক অ্যান্ড ডান্স-এ। বন্ধুদের মধ্যে রয়েছেন তুরস্কের প্রথিতযশা পিয়ানো শিল্পী গোরকেম আঘার, যিনি লিয়নের এই সঙ্গীতবিদ্যালয়ে কম্পোজ়িশন নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা ও আবহসঙ্গীত নির্মাণ করেন। গোরকেমের সঙ্গে মিলিত শৈল্পিক সহযোগে, রবীন্দ্রনাথের ‘শেষ গানেরই রেশ নিয়ে যাও চলে’ ইউটিউব ও ফেসবুকে আমাদের শ্রোতাদের মধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। অনেকেই আমাকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, এই ছেলেটি কে? কী ভাবে এমন করে বুঝল রবীন্দ্রনাথের গান? ভাষা না বোঝা সত্ত্বেও? উত্তরে হেসেছি শুধু। কারণ এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করেছেন, লিয়নের স্থানীয় সঙ্গীতশিল্পী, জ্যাক মাদজার। জ্যাক পাশ্চাত্য-শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি মন দিয়ে অধ্যয়ন করেছে ফ্ল্যামেনকো গিটার, এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত! সেতার ও গিটারে তার অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্য। জ্যাক রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে ভালবাসে এবং রেকর্ডও করেছে, এ কথা শুনে আমি বাকরহিত! ইউটিউবে ওর অবলীলায় গাওয়া ‘সমুখে শান্তিপারাবার’ শুনেই ঠিক করে ফেললাম, আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবেই। জ্যাকের সার্বিক উদ্যোগে একটি ভারতীয় শিল্পোৎসবের অনুষ্ঠানে থাকবে রবীন্দ্রনাথের গান, এমনটাই পরিকল্পনা করা হল। কিন্তু যন্ত্রানুষঙ্গে কে থাকবেন? জ্যাকেরই বহু দিনের বন্ধু বিখ্যাত পিয়ানিস্ট, ভ্যালেন্টিন এসকন্দ। তাঁর পড়াশোনা লিয়নের সঙ্গীতবিদ্যালয়েতেই শুধু নয়, প্যারিস কনজ়ারভেটরিতেও। ভ্যালেন্টিন এলেন আমাদের রবীন্দ্রনাথের গানের অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে। আগেই ঠিক হয়েছিল যে, রবীন্দ্রনাথের গান আমরা ফরাসি অনুবাদ-সহ পেশ করব। ঠিক হয়, অনুষ্ঠানে থাকবে বিখ্যাত ফরাসি ভারতবিদ অ্যালাঁ দানিয়েল্যু-কৃত অনুবাদ।। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ১৫টি বিবিধ মেজাজের গানের তালিকা তৈরি করা হল, যার মধ্যে রইল— ‘আনন্দেরই সাগর হতে’র মতো শরতের গান ও ‘আমার পরাণ যাহা চায়’, ‘যদি প্রেম দিলে না প্রাণে’-র মতো প্রেম পর্যায়ের গান।

কিন্তু কোথায় হবে এমন এক অনুষ্ঠান? কে-ই বা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন আমাদের? এগিয়ে এলেন জনৈক ক্যাফের মালিক ও অ্যালাঁ দানিয়েল্যু ফাউন্ডেশনের কর্ণধারেরা। যাঁকে রবীন্দ্রনাথ তার সঙ্গীতভবনের দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন তাঁর অনুবাদ আমরা পেশ করব শুনে সব ব্যবস্থা করে দিলেন তাঁরাই।

Advertisement

অনুষ্ঠান শুরু হল ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’ দিয়ে, জ্যাক সঙ্গত করলেন দোতারায় এবং ভ্যালেন্টিন পিয়ানোতে। সামনে বসা ফরাসি মুখ-চোখগুলিতে ভাললাগার ঝিলিক। একে একে ‘এরে ভিখারি সাজায়ে’, ‘যদি প্রেম দিলে না প্রাণে’-র ফরাসি উপস্থাপনা শুনে ফরাসি শ্রোতাদের একাংশ উদ্বেল। এর পরেই জ্যাকের ‘মায়াবনবিহারিণী হরিণী’র প্রফুল্লিত উপস্থাপনায় আমোদ পেলেন সবাই। মাঝেমাঝে পঠিত হচ্ছিল গীতাঞ্জলির কিছু কবিতার ফরাসি অনুবাদ। ‘নিভৃতপ্রাণের দেবতা’ বা ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়’-এর মতো গুরুভাবের গান যখন গাওয়া হচ্ছে, তখনও দেখলাম, মনোযোগ সহকারে শুনছেন ফরাসি শ্রোতারা। অনুষ্ঠানের শেষ গান ‘এ পরবাসে রবে কে’। আগাগোড়া পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয়-সঙ্গীতে দীক্ষিত ভ্যালেন্টিন টপ্পা অঙ্গের এই গানটির সঙ্গে সঙ্গত করতে পারবেন কি না, এ নিয়ে আমাদের সমস্ত সংশয় ভাসিয়ে ভ্যালেন্টিন যখন সুরের জাল বুনলেন, তখন বুঝলাম সঙ্গীত সত্যি-সত্যিই ভাষা-কাল-দেশ-জাতি-বর্ণ অতিক্রম করে ওঠা মানব সম্পদ!

অনুষ্ঠান শেষ হল করতালির অনুরণনে। এক ফরাসি অধ্যাপিকা বলে উঠলেন, ‘‘কী সম্পদ শোনালেন! কী ঐশ্বর্য এই গানে!’’ একটি ফরাসি মেয়ে বলল, ‘‘টেগোর দারুণ কম্পোজ়ার।’’ অনেকেই ঘিরে ধরলেন শিল্পীদের, রবীন্দ্রনাথকে জানতে চাওয়ার নিবিড় আকাঙ্ক্ষায়। তাঁদের আকাঙ্ক্ষাগুলো গভীর হয়ে মর্ম ভেদ করে কোথায় যেন সায়াহ্নের নীল আঁধারে মিলিয়ে গেল এবং আমাদের মনন ঘিরে তখন বাজতে শুরু করল— ‘বিশ্ব-সাথে যোগে যেথায় বিহারো, সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো...।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement