আমরুল্লা সালেহ। —ফাইল চিত্র।
রাজনৈতিক চাপে পড়েও আদর্শ থেকে সরে আসেননি তিনি। বরং পদ থেকেই ইস্তফা দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই আমরুল্লা সালেহ-ই এ বার আফগানিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে। আগামী মাসে সে দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তাতে দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আশরফ গনি। তাঁর সঙ্গেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ে নামছেন, এককালে গনির কট্টর সমালোচক আমরুল্লা। তালিবানের উপস্থিতিতে নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন হবে কিনা, তা নিয়ে এই মুহূর্তে সংশয়ে গোটা দেশ। তবে নিজেদের স্বার্থেই মানুষ পছন্দের নেতা বেছে নেবেন বলে আশাবাদী তিনি।
বরাবর তালিবানের কট্টর সমালোচক হিসাবেই পরিচিত আমরুল্লা সালেহ। ‘প্রকৃত দেশপ্রেমী’ হিসাবেও দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় তিনি। যদিও আর পাঁচ জন রাজনীতিকের চেয়ে অনেকটাই আলাদা তিনি। প্রাণ হাতে করেই জীবনের বেশির ভাগ সময়টা কাটিয়ে দিয়েছেন। তাই এই মুহূর্তে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এই পর্যায়ে পৌঁছতে চরম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও যেতে হয়েছে তাঁকে।
সে দেশের সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, কাবুলের উত্তরে পাঞ্জশিরে জন্ম আমরুল্লা সালেহর। কিন্তু অনাথ হিসাবেই বড় হয়েছেন তিনি। সেইসময় আহমদ শাহ মাসুদের নেতৃত্বে সোভিয়েতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আর সেই সূত্রেই আফগান রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মার্কিন হানার পর ২০০১ সালে তাঁকে দেশের গুপ্তচর সংস্থা ন্যাশনাল ডিরেক্টরেট অব সিকিয়োরিটি (এনডিএস)-এর প্রধান নিযুক্ত করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই। কিন্তু ২০১০ সালে কাবুলে একটি বিস্ফোরণ নিয়ে কারজাইয়ের সঙ্গে বিরোধ বাধে তাঁর। হামলায় তালিবান যোগ থাকার কথা মানতে চাননি কারজাই। তার জেরে ইস্তফা দিয়ে দেন আমরুল্লা সালেহ। তার জেরে জনমানসে পাকা জায়গা করে নেন তিনি। পরে নিজের দল ‘আফগানিস্তান গ্রিন ট্রেন্ড’ও গঠন করেন। সেইসময় একাধিক বার প্রকাশ্যে আশরফ গনির সমালোচনা করতে দেখা যায় তাঁকে। তা সত্ত্বেও ২০১৮-য় তাঁকে দেশের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী নিযুক্ত করেন প্রেসিডেন্ট আশরফ গনি।
হামলার পর এমনই অবস্থা হয়েছিল আমরুল্লা সালেহ-র দফতরের। ছবি: সংগৃহীত।
আরও পড়ুন: ‘আইএস জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে পাকিস্তান’, অভিযোগ আফগান রাজনীতিকের
তবে তালিবানের সঙ্গে নিঃশর্ত সমঝোতা নিয়ে বরাবর আপত্তি তুলে এসেছেন তিনি। তাঁর যুক্তি এত দিন ধরে দেশে নাশকতা চালিয়ে এসেছে তালিবান। তাতে হাজার হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণ গিয়েছে। তাই কোনওরকম শাস্তি চাড়া সমঝোতার প্রশ্নই ওঠে না। এই তালিবান বিরোধিতার জন্য কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি আমরুল্লা সালেহকে। একাধিক বার তাঁকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। আশরফ গনির সঙ্গে ভাইস প্রেসিডেন্টের দৌড়ে নাম লেখানোর খবর সামনে আসার পর গত ২৮ জুলাই তাঁর উপর হামলা চালায় এক দল জঙ্গি। কাবুলে তাঁর দফতরের বাইরে প্রথমে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। তাতে প্রাণ হারান ২০ জন। কমপক্ষে ৫০ জন গুরুতর জখম হন।
এর পরে চারতলা বিল্ডিংয়ে আমরুল্লা সালেহ-র কেবিনে ঢুকে পড়ে সশস্ত্র জঙ্গিরা। কিন্তু তত ক্ষণে জানলা দিয়ে মই বেয়ে ছাদে উঠে গিয়েছেন আমরুল্লা। সেখান থেকে পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে লাফিয়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান তিনি। পরে যদিও এর জন্য আফশোস করতে দেখা যায় তাঁকে। একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘‘আমি পালিয়ে গেলেও, জঙ্গিদের হাতে প্রাণ হারান আমার কয়েক জন সহযোগী। জখমও হন কয়েক জন। পর দিন সরকারি হাসপাতালে তাঁদের দেখতে যাই আমি। সেখানে আমাকে দেখে চটে ওঠেন মৃতদের মধ্যে এক জনের পরিবারের সদস্য। সপাটে থাপ্পড় মারেন। সেইসময় নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। তাই জানতে চেয়েছিলাম, আমার মৃত্যুতে শান্তি পাবেন কি উনি? হ্যাঁ বলায়সঙ্গে সঙ্গে ওঁর হাতে রিভলভার তুলে দিই। শেষ করে দিতে বলি আমাকে। কিন্তু রিভলভার ফিরিয়ে দেন উনি।’’
যে কোনও মুহূর্তে তাঁকে মেরে ফেলা হতে পারে, তাই আগে থাকতেই নিজের উইল করে রেখেছেন বলেও জানিয়েছেন আমরুল্লা সালেহ। তাঁর কথায়, ‘‘সারা ক্ষণ জঙ্গিদের নিশানায় রয়েছি। তাই উইলও তৈরি করে রেখেছি। পরিবার ও বন্ধুদের বলে রেখেছি, আমাকে মেরে ফেললে দুঃখ কোরো না। কারও কাছে অভিযোগ কোরো না। কারণ ওদের মধ্যে অনেককে আমি নিজে হাতে শেষ করেছি। তার জন্য কোথাও কোনও অপরাধ বোধ নেই। বরং গর্ব বোধ করি।’’
আরও পড়ুন: কুলভূষণের সাক্ষাৎ নিয়েও দ্বন্দ্বে দুই দেশ
এই মুহূর্তে আফগানিস্তানের দিকে তাকিয়ে গোটা বিশ্ব। দীর্ঘ ১৮ বছর পর সেখান থেকে সেনা সরিয়ে নিতে উদ্যোগী হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন মার্কিন সরকার। তাই এখন তালিবানদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। তার জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও টানাপড়েন চলছে। শুরুতে ২০ এপ্রিল নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। পরে তা পিছিয়ে ২০ এপ্রিল করা হয়। ফের তা পিছিয়ে আনা হয় ২৮ সেপ্টেম্বরে। কিন্তু শেষমেশ তা হয়ে উঠবে তো? সে দেশের রাজনৈতিক মহলে তো বটেই আন্তর্জাতিক মহলেও এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু সুষ্ঠু ভাবেই নির্বাচন সম্পন্ন হবে বলে আশাবাদী সালেহ। তাঁর মতে, ‘‘নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এ বার ভোট দিতে উৎসুক সাধারণ মানুষ।’’ নিজের জয় নিয়েও নিশ্চিত তিনি।