বংশে তিনি-ই প্রথম পেরিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি। তখনও কেউ ভাবতে পারেননি একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন তিনি। সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করে দেখালেন শ্রমিক পরিবারের মেয়েটি। ৩৪ বছর বয়সে দায়িত্ব নিয়েছেন ফিনল্যান্ডের। শুধু ওই দেশেরই নন, সানা ম্যারিন সারা বিশ্বের কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী।
ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে সানার জন্ম ১৯৮৫ সালের ১৬ নভেম্বর। জন্মগত নাম সানা মিরেলা ম্যারিন। ১৯ বছর বয়সে ২০০৪ সালে তিনি হাই স্কুল উত্তীর্ণ হন। তিন বছর পরে স্নাতক হন ইউনিভার্সিটি অব ট্যাম্প্রে থেকে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সায়েন্সেস বিষয়ে। রাজনীতিতে প্রবেশ ২৭ বছর বয়সে।
ট্যাম্প্রে সিটি কাউন্সিলের সদস্য হন সাতাশেই। এরপর চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব। ২০১৪ সালে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির দ্বিতীয় ডেপুটি চেয়ারপার্সন হন তিনি। ২০১৫ সালে ৩০ বছর বয়সে প্রথমবার ফিনল্যান্ড পার্লামেন্টের সাংসদ নির্বাচিত হন ম্যারিন। ২০১৯ সালের ৬ জুন দায়িত্ব নেন দেশের যোগাযোগ ও পরিবহণমন্ত্রী হিসেবে।
ডাকবিভাগে ধর্মঘট নিয়ে মতপার্থক্যের জেরে জোটসঙ্গী সেন্টার পার্টি সমর্থন তুলে নেওয়ায় সম্প্রতি সরকার ভাঙে ফিনল্যান্ডে। আস্থা ভোটে হেরে গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন অ্যান্টি রিনে। সেই শূন্য আসনেই ম্যারিনকে নির্বাচিত করেছেন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা। খুবই অল্প ভোটে জিতে তিনি মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিচ্ছেন।
রাজনীতি-বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ম্যারিনের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। ডাকবিভাগের ৭০০ কর্মীর বেতন ছাঁটাই নিয়ে এখনও অচলাবস্থা রয়েছে এই স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশটির একাংশে। চাপের মুখে পদত্যাগ করেছেন দলীয় নেত্রী। পিছু হটেছেন ডাক বিভাগের সংস্কার সিদ্ধান্তেও। এখন রিনের উত্তরসূরি হিসেবে যাবতীয় পরিস্থিতি সামলাতে হবে কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রীকে।
তরুণ তুর্কী ম্যারিন অবশ্য আত্মবিশ্বাসী। স্পষ্ট জানিয়েছেন, ‘‘বয়স বা লিঙ্গ নিয়ে আমি কোনও দিন ভাবিনি। কেন আমি রাজনীতিতে এসেছি, সেটাই ভাবি। ভাবি, কেন আমি দলের আস্থাভাজন হলাম। যথাযথ ভাবে নিজের দায়িত্বপালনের চেষ্টা করব।’’
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ফিনল্যান্ডের উপরেও গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর চাপ রয়েছে। এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পরিবেশ রক্ষায় দায়বদ্ধ থাকার বার্তা দিয়েই ম্যারিন বললেন, ‘‘দেশ তথা গোটা বিশ্বের আস্থা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক কাজ করতে হবে।’’
তবে এই নর্ডিক দেশের বড় অংশ এই নির্বাচন ঘিরে বেশ উৎসাহী। কারণ, ফিনল্যান্ডে যে পাঁচ দলের জোট সরকার, তার প্রত্যেকটির নেতৃত্বে রয়েছেন মেয়েরা। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিতে ম্যারিন, বামপন্থী জোটের নেতৃত্বে বছর বত্রিশের লি অ্যান্ডারসন, মধ্যপন্থী জোটে ৩২ বছর বয়সি ক্যাট্রি কালমানি, গ্রিন লিগে ৩৪ বছরের মারিয়া ওহিসালো এবং সুইডিশ পিপলস পার্টি অব ফিনল্যান্ডের নেতৃত্বে আছেন ৫৫ বছর বয়সি অ্যানা-মাজা হেনরিকসন।
এর আগে বিশ্বের কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইউক্রেনের ওলেক্সি হোঞ্চারুক। সম্প্রতি ৩৫ বছর বয়সে তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব নেন। তাঁকে রেকর্ডের দৌড়ে টেক্কা দিয়েছেন সানা ম্যারিন।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডের্নের বয়সও চল্লিশ পার হয়নি। ইতিমধ্যেই তাঁর সঙ্গে ম্যারিনের তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছে। জেসিন্ডার মতো ম্যারিনও সদ্য মা হয়েছেন। ম্যারিনের মেয়ে এমার বয়স এখনও দু’বছর হয়নি। এমার জন্ম ২০১৮-র জানুয়ারিতে।
ম্যারিন অবশ্য এখনও বিয়ে করেননি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে লিভ ইন করছেন পার্টনার মার্কাস রাইক্কোনেনের সঙ্গে। ভবিষ্যতে বিয়ের পরিকল্পনা আছে দু’জনের।
যে পরিবারে ম্যারিনের বড় হওয়া, সেটিও বেশ বৈচিত্রময়। ম্যারিন নিজে সমলিঙ্গ দম্পতির সন্তান। ‘সমলিঙ্গ বাবা-মা’ বা ‘সেমসেক্স কাপল’ একটি বিস্তৃত ধারণা। এলজিবিটি পেরেন্টিং বলতে বোঝায় সেই সব লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল এবং ট্রান্সজেন্ডারদের, যাঁরা শিশুদের লালনপালন করছেন।
এ রকমও হতে পারে, একজন এলজিবিটি মানুষ হয়তো সিঙ্গল পেরেন্ট হয়ে শিশুকে বড় করলেন। বা, পুরুষ-মহিলা জুটি, যাঁদের মধ্যে দু’জনই, বা অন্তত একজন হয়তো এলজিবিটি-মনস্ক। সে ক্ষেত্রেও বলা হবে এলজিবিটি পেরেন্টিং বা সেমসেক্স পেরেন্টিং।
কোপেরেন্টিং, সারোগেসি, ডোনার ইনসেমিনেশন, রেসিপ্রোক্যাল আইভিএফ, বা দত্তকগ্রহণ— এর মধ্যে যে কোনও উপায়ে সন্তানলাভ করেত পারেন এলজিবিটি জুটি। তবে নিজের ব্যক্তিগত জীবন সংবাদমাধ্যম থেকে গোপন রাখতেই পছন্দ করেন সানা। নিজের সম্বন্ধে শুধু এ টুকু বলেন, তিনি রামধনু পরিবারের সন্তান।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ম্যারিনের শৈশব কেটেছে ভাড়াবাড়িতে। তাঁকে বড় করে তোলেন মা এবং মায়ের সঙ্গিনী। পারিবারিক পরিচয় দিতে শৈশবে বারবার হোঁচট খেয়েছেন তিনি। জানিয়েছেন ম্যারিন নিজেই। গুটিয়ে রাখতেন নিজেকে। কিন্তু তাঁকে বরাবর আত্মবিশ্বাস আর সাহস জুগিয়েছেন তাঁর জন্মদাত্রী। এখন দেশবাসীর ভরসাকে অটুট রাখার দায়িত্ব চৌত্রিশটি বসন্ত পেরোনো সানা ম্যারিনের কাঁধে। (ছবি: ফেসবুক)