ঔরঙ্গজেবের আমলে দলবল সমেত মুঘল সেনাপতি শায়েস্তা খাঁর হাতে ধরা পড়েছিলেন জলদস্যু সেবাস্তিয়ান গঞ্জালেস। ইতিহাসের সেই কাহিনিকে নতুন মোড়কে আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তবে সময় যত এগিয়েছে জল থৈ থৈ সাগরে যাঁদের অবাধ বিচরণ, সেই জলদস্যুদের কাহিনির প্রতি আমাদের আকর্ষণ বেড়েছে।
আরব সাগর ও লোহিত সাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের দাপিয়ে বেড়ানোর গল্পও বেশ জনপ্রিয়। মাঝ সমুদ্রে বড় জাহাজ লুঠ করার সময়, তাদের যে নৃশংস আচরণ ধরা পড়ত, তা সর্বত্র প্রচারিত। কিন্তু সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা এই সমস্ত মানুষ জলদস্যু হয়ে উঠলেন কী ভাবে, সাগরের বুকে তাঁদের এত দাপটই বা কী ভাবে?
১৬৫০ থেকে ১৭৩০ পর্যন্ত জলদস্যুদের দাপট ছিল সবচেয়ে বেশি। সেই সময় সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে অভিযানে বেরতো বহু দেশ। দীর্ঘ যাত্রাপথে জাহাজের শ্রমিকদের সঙ্গে প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করা হতো। ঠিক মতো খেতেও দেওয়া হতো না। কাজে কোনও খুঁত ধরা পড়লেই চাবুক মারা হতো। এমনকি শাস্তি হিসেবে জাহাজ থেকে শ্রমিকদের মাঝ সমুদ্রে ফেলে দেওয়াও হতো।
আরব সাগর ও লোহিত সাগরের মাঝে আফ্রিকার যে অংশটি শিংয়ের মতো দেখতে সেটিই সোমালিয়া। চিরকালই দারিদ্রের শিকার এই দেশটি। তবে বিগত শতাব্দির নব্বইয়ের দশকে তা চরম আকার ধারণ করে।
১৯৯৫ সালে দেশের স্বৈরাচারী শাসক মহম্মদ সৈয়দ বারের মৃত্যুর পর দেশ জুড়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। চরম অর্থ সঙ্কট দেখা দেয় দেশ জুড়ে। তার ফলশ্রুতি হিসাবেই সোমালিয়ার উপকূলে জলদস্যুদের উত্থান ঘটে, যা সমুদ্রপথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিভীষিকার পরিণত হয়।
১৯৯১ সালে সোমালিয়ায় সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর সোমালিয়ার জলসীমায় বহু ইউরোপীয় জাহাজ রহস্যজনক ভাবে ঘোরাফেরা করতে শুরু করে। সোমালিয়া উপকূলের কাছে বিরাট বিরাট ব্যারেল ফেলতে থাকে তারা। জলের তোড়ে ভেসে আসা ওই সব ব্যারেলে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ থাকত।
এই সব বর্জ্য পদার্থের সংস্পর্শে এসে সোমালিয়ার উপকূলবাসীরা অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করেন। নানা রকম অদ্ভুত রোগ দেখা দেয় তাঁদের মধ্যে। এমনকি গর্ভবতীরা বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম দিতে শুরু করেন।
২০০৫ সালে সুনামির পর এই রকম হাজার হাজার ব্যারেলে ভরে যায় সোমালিয়ার উপকূল অঞ্চল। জানা যায়, ইউরোপের বিভিন্ন হাসপাতাল ও কারখানা থেকে ইতালীয় মাফিয়াদের হাত ঘুরে ওই সব বর্জ্য পদার্থ সোমালিয়ার উপকূলে খালাস করা হচ্ছিল, যার মধ্যে সীসা, ক্যাডমিয়ামের মতো ক্ষতিকারক পদার্থ ছিল। এগুলি সোমালিয়ার উপকূল এলাকার জলে মিশতে থাকে।
বিষয়টি জানাজানি হলেও এ নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি ইউরোপীয় সরকারগুলিকে। ক্ষতিগ্রস্ত সোমালীয়দের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করা হয়নি। ওই একই সময়ে ইউরোপীয় মাছ ধরার জাহাজগুলি সোমালিয়ার উপকূলে ভিড় করতে থাকে। সেখান থেকে মাছ লুঠ করে নিয়ে গিয়ে ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে তাদের।
এতে স্থানীয় জেলেরা জীবিকাহীন হয়ে পড়তে থাকেন। ধীরে ধীরে তাঁরা নিজেরাই এই লুঠ রুখতে তৎপর হন। বেআইনি ভাবে ইউরোপীয় দেশ থেকে যে সমস্ত জাহাজ তাদের উপকূল থেকে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল এবং ক্ষতিকারক বর্জ্য ফেলে উপকূলকে দূষিত করছিল, তাদের তাড়াতে সোমালিয়ার উপকূলের অধিবাসীদের একাংশ ছোট ছোট নৌকো এবং স্পিডবোট নিয়ে নিজেরাই জলে নেমে পড়েন।
কিন্তু বড় বড় জাহাজগুলির সঙ্গে কিছুতেই যুঝে উঠতে পারছিলেন না সোমালিয়ার সাধারণ মানুষ। মাছ ধরার জাহাজগুলির উপর কিছুতেই শুল্ক বসাতে পারছিলেন না তাঁরা। এমন অবস্থায় বর্জ্য ফেলতে আসা বেশ কিছু জাহাজকে আটক করতে সক্ষম হন সোমালিয়ার ওই সব সাধারণ মানুষ।
আর তাতেই আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় তাঁদের। এ ভাবে জাহাজ তাড়ানোর চেয়ে সেগুলিকে ছিনতাই করে মুক্তিপণ আদায়ই সহজ বলে মনে হয় তাঁদের একাংশের। সেই মতো হাতে অস্ত্র তুলে নেন তাঁরা। সেখান থেকেই আধুনিক সোমালিয়ার জলদস্যুদের উত্থান।
সমুদ্রের নাড়ি-নক্ষত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ায় স্থানীয় জেলে ও প্রাক্তন সেনা সদস্যদের একাংশ মিলে জলদস্যু দল তৈরি করতে শুরু করেন। তাঁদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন সোমালিয়ার সাধারণ মানুষও। স্থানীয়দের অধিকাংশেরই মতে, সমুদ্র প্রতিরক্ষায় জলদস্যুতাই একমাত্র উপায় তাদের কাছে। যে কারণে বহু অল্প বয়স ছেলেমেয়েও জলদস্যুদের দলে যোগ দিতে শুরু করে।
২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী জাহাজগুলির জন্য রীতিমতো বিভীষিকা হয়ে ওঠে এই জলদস্যু দলগুলি। বিদেশি পণ্যবাহী জাহাজ ছিনতাই করে মুক্তিপণের মাধ্যমে টাকা রোজগার করতে শুরু করে তারা।
তবে ২০১৩ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মহল, রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং ন্যাটোর হস্তক্ষেপে সমুদ্রের বুকে জলদস্যুদের আক্রমণের ঘটনা অনেকটাই কমে এসেছে।