অন্য ছবি: ভাঙচুর হওয়া থানা পাহারা নাগরিকদের। ছবি: পিটিআই।
থানার সামনে পড়ে রয়েছে অসংখ্য দেহ। কয়েক জনের পরনে পুলিশের পোশাক। এক জনের হাতে হাতকড়া।
ভস্মীভূত বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে রাখা হয়েছে চারটি দগ্ধ দেহ। দু’জনকে দেখে মনে হয়, সদ্য তারুণ্যে পা দিয়েছিল তারা। এক জন আবার ১২-১৩ বছরের কিশোর। ছেলের দেহের সামনে রাস্তায় বসে হাহাকার করছিলেন এক তরুণের মা।
এই দৃশ্য দেখে মনে পড়িয়ে দেয় দিন কুড়ি আগে আর এক মায়ের আর্তনাদ— ‘চাকরি না দিবি না দিবি, আমার ছেলেকে মারলি কেন তোরা!’ পুলিশের গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে, তারপরে গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, ‘বিক্ষোভের মুখ’ হয়ে উঠেছিলেন সেই মায়ের ছেলে, রংপুরের তরুণ আবু সাইদ। সেটা ১৬ জুলাইয়ের কথা। তার পরে ছাত্র বিক্ষোভ যত দানা বেঁধেছে, হাসিনা সরকারের পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা তত লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সাত দিনে অন্তত দু’শো জন নিহত হয়েছিলেন বলে সংবাদমাধ্যমের খবর।
সংরক্ষণ কমানোয় সুপ্রিম কোর্ট সায় দেওয়ার পরে সবাই আশা করেছিলেন, মৃত্যুমিছিল এ বার বন্ধ হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। গত কাল শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেওয়া ও দেশে সেনাশাসন কায়েম হওয়ার পরেও সাধারণ মানুষের আশা ছিল, শান্তি ফেরবে। কিন্তু বাস্তবে তা হল কই? ঢাকা-সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে রবিবার শুধু প্রবল ভাঙচুর ও লুটপাট চালানোর সঙ্গে নির্বিচারে অগ্নিসংযোগ ও হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। রবি থেকে মঙ্গল, এই তিন দিনে দেশ জুড়ে অসংখ্য হিংসাত্মক ঘটনায় মৃতের সংখ্যা পাঁচশো ছুঁয়েছে। দাঙ্গাকারীদের নিশানায় আওয়ামী লীগ সমর্থক ও সংখ্যালঘুরা। এবং পুলিশকর্মীরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, অনেকের মৃত্যু হয়েছে দুর্ঘটনাতেও।
যেমন ঢাকার ৩২ নম্বর ধানমন্ডি। শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনটি সংগ্রহশালা করে রাখা হয়েছিল। গতকাল ব্যাপক লুটতরাজ চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় তিনতলা ভবনটিতে। সেই বাড়ি-লাগোয়া সান্তুর রেস্টুরেন্টটিও সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছিল। আজ দুপুরে সেখানে দমকল ঢুকে চারটি মৃতদেহ উদ্ধার করে। তাদের মধ্যে এক জনের পরিচয় পাওয়া গিয়েছে।
জানা গিয়েছে, ১৭ বছর বয়সি ইউসুফ হোসেন ধানমন্ডি মাল্টিফিড স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী। কী ভাবে সে এখানে এল তা বুঝতে পারছেন না হতবাক মা। শুধু বলছেন, ‘‘ছেলে বলেছিল, দেশ স্বাধীন করতে যাচ্ছি।’’ স্থানীয়দের দাবি, লুটতরাজ করতে জ্বলন্ত বাড়িতে ঢুকেছিলেন অনেকে। সেখান থেকেই আর হয়তো বার হতে পারেননি তাঁরা।
আজ বেলা ১২টা নাগাদ ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানার সামনে সাতটি দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে দু’জনের শরীরে পুলিশের পোশাক এবং এক জনের হাতে হাতকড়া পরানো রয়েছে। জানা গিয়েছে, গত কাল বিকেলে এই থানায় হানা দেন বিক্ষোভকারীরা। পুলিশকে আক্রমণ করেন তাঁরা। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। পুলিশের গুলিতে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন বলে দাবি। তাঁদের দেহ যাত্রাবাড়ী থানায় রয়েছে।
কুমিল্লার অশোকতলায় প্রাক্তন কাউন্সিলর শাহ আলমের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। নিহত হয় ছ’জন। তাদের মধ্যে পাঁচ জনই কিশোর, বয়স ১২ থেকে ১৭-র মধ্যে।
সাতক্ষীরাতেও রাজনৈতিক কর্মীদের বাড়িতে হামলায় অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে দু’জন বিএনপি-র সদস্য, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। সিলেটেও আওয়ামী লীগের অন্তত ২৫ জন শীর্ষ পর্যায়ের নেতার বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। হতাহতের সংখ্যা স্পষ্ট নয়।
বঙ্গবন্ধুর সংগ্রহশালা, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন-সহ ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ভবনে কাল থেকে যে লুট হয়েছে, তার প্রতিরোধ করেছে ছাত্রসমাজ। তরুণ প্রজন্মের ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন মইনুর রহমান নামে আর এক জন। একটি ভিডিয়ো ফেসবুকে পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, ‘আপনারা দেখেছেন গণভবনে অবাধে লুট চলছে। কিন্তু মুদ্রার অন্য পিঠও ছিল। আমরা শিক্ষার্থীরা বহু মানুষকে লুট করা থেকে বিরত করতে পেরেছিলাম। বলেছিলাম, ‘এ ভাবে জিনিস নিয়ে যাবেন না। এগুলি আমাদেরই সম্পদ। নিয়ে গেলে আমাদের টাকায় এগুলি কিনতে হবে। আমাদের আবেদন অনেকেই শুনেছেন’।