ছবি রয়টার্স।
এ এক অদ্ভুত দৃশ্য! হঠাৎ দেখলে মনে হবে, শহরটা উৎসবে মেতেছে। পার্কে, রাজপথে আমেরিকানদের বিদায় উদযাযাপন চলছে! তবে সত্যিই কি আফগানিস্তানের মন বোঝা অত সহজ? কাবুলবাসীর মনের মধ্যে এখন কী ঝড় বইছে, তা ওই ক’টা ছবি দিয়েই হয়তো বোঝা যাবে না।
আজ (মঙ্গলবার) সকালে আমিও কাবুল বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম। আমেরিকার কব্জামুক্ত বিমানবন্দর ঘিরেই উচ্ছ্বাসের মেজাজ। কাবুলে থাকলেও আমাদের পারিবারিক ভিটে পাকিস্তান লাগোয়া পাকতিকা প্রদেশের শারানা জেলায়, হাজি আসগর গ্রামে। সেই গ্রামতুতো সম্পর্কের এক জন এখন বিমানবন্দরে গুরুত্বপূর্ণ জিম্মেদারি (দায়িত্ব) পেয়েছে। আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সে-ও এত দিন তালিবানের হয়েই লড়াই করছিল। বিমানবন্দর থেকে টুয়েলফথ ডিস্ট্রিক্টে আমার বাড়ির কাছে এসেও দেখছি রাস্তায় ভিড়। বাজি ফাটিয়ে উৎসব চলছে। আমিও সেখানেই গিয়ে হাসিমুখে দাঁড়ালাম।
তবে মুখের হাসি দিয়ে আফগানিস্তানের মনকে বিচার করতে যাবেন না! দু’দশক ধরে যুদ্ধে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেশটা এক ফোঁটা শান্তির জন্য আকুল হয়ে আছে। তালিবান কি সেই শান্তি আনতে পারবে! বিমানবন্দরে দেখলাম, অনেকের ক্ষোভ, আমেরিকানরা বেশ কিছু যন্ত্রপাতি খারাপ করে গিয়েছে। আকাশে আমেরিকান চপারের ভিডিয়ো দেখিয়ে তালিবরা দাবি করছে, ওরা নাকি চক্কর কেটে নজরদারি চালাচ্ছে। শুনছি, কাবুল বিমানবন্দর কয়েক দিনের মধ্যে তালিবরা চালু করবে। কিন্তু কাবুলের সাধারণ লোক এই মুহূর্তে পরিস্থিতি নিয়ে সংশয়ে। আমেরিকার দু’দশক ধরে রক্তক্ষয়ী অপচয়ের ফল একটা বিরাট শূন্য। এই নিয়ে ক্ষোভও বাস্তব। আবার অনেকের সন্দেহ, কাবুল ছাড়লেও ঠারেঠোরে ওরা ঠিকই মাথা গলাবে। আইএসআইএস খোরাসানের মতো গোষ্ঠীর নাম শুনছি। সাধারণ লোকের সন্দেহ, পশ্চিমের রাষ্ট্রশক্তিও তাদের মদত দিতে পারে। অনেক বিদেশি রাষ্ট্রেরই স্বার্থসিদ্ধি হতে পারে, আফগানিস্তানে সন্ত্রাস চললে। তখন আবার সন্ত্রাসকবলিত দেশ ঘোষণা করে শিগগিরই বিদেশিরা ফিরতে পারে!
ঠিক এক দিন আগে বিমানবন্দরের কাছে ড্রোন হানায় শহরের শিশুমৃত্যুর ঘটনাও অনেককে নাড়া দিচ্ছে। একটা ভয় কাজ করছে, আফগানিস্তানে অশান্তি চললে অনেক নিরীহ মানুষকে নিশানা করা হতে পারে! ভারতীয়রাও টার্গেট হতে পারেন, এই আশঙ্কাও অনেকের মধ্যে কাজ করছে। এ সবের ফলে, রাজনীতির কী উদ্দেশ্যসিদ্ধি হবে তা পরের কথা! কিন্তু অযথা রক্তক্ষয়ের যন্ত্রণায় ভোগা ভবিতব্য।
আর যদি শান্তি আসেও কিসের বিনিময়ে আসবে, তাও ভাবছে সাধারণ মানুষ! দেশের উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের আলাদা ক্লাসের কথা বলেছে। আশঙ্কা, এর পরের পদক্ষেপ কি মেয়েদের শিক্ষাই বন্ধ করা! আপাত ভাবে অবশ্য সব স্বাভাবিক। ছেলেমেয়ের বেসরকারি স্কুল খোলা। অফিস খোলা থাকলেও এখনও ব্যাঙ্ক বন্ধ। দেশে মুদ্রা বিনিময়, ব্যাঙ্ক লেনদেন হচ্ছে না। একটা প্রেসিডেন্টহীন বা সরকারহীন দেশে কাজকর্ম হবে কী করে! পঞ্জশিরের লড়াইটা অবশ্য মনে হচ্ছে, শেষমেশ থেমে যাবে। সকলেই তো আফগান। শান্তিপূর্ণ সমাধানের বিষয়ে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের উপরে আস্থা রাখা ছাড়া আমাদের কী উপায় বলুন! সকলেই যুদ্ধ দেখে দেখে ক্লান্ত। শান্তির দরকারটা আফগানদের থেকে কে-ই বা বেশি বোঝে।
লেখক কাবুলবাসী ইঞ্জিনিয়ার