সেই ভয়ঙ্কর পুতুলের কথা মনে আছে? সে কোনও সাধারণ পুতুল ছিল না। আশেপাশে কি ঘটছে সবটাই বুঝতে পারত, নজর রাখত। সারা বাড়ি ছোটাছুটি করত। অদ্ভুত গলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারত।
ছোটদের সিনেমার সেই ‘ভূত পুতুল’। কিন্তু জানেন কি সিনেমার সেই ভূত পুতুল ‘চাকি’ বাস্তবেও ছিল?
বাস্তবের চাকির নাম ছিল রবার্ট। ফ্লোরিডার কি ওয়েস্টের বাসিন্দা রবার্ট ইউজিন ওটো নামে এক ব্যক্তির ছিল পুতুলটি। তিনিই পুতুলের নাম দিয়েছিলেন রবার্ট দ্য ডল।
পুতুলটি জার্মানির সেইফ কোম্পানিতে তৈরি করা হয়েছিল। ১৯০৪ সালে ওটোর ঠাকুরদা জার্মানি গিয়েছিলেন। তখনই নাতির জন্মদিনের উপহার হিসাবে পুতুলটি কিনেছিলেন।
রবার্ট এবং ইউজিন খুব তাড়াতাড়ি একে অপরের ভাল বন্ধু হয়ে যায়। ইউজিন যেখানেই যেতেন রবার্টকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। ডাইনিং টেবিলেও রবার্টের জন্য একটা আলাদা জায়গা থাকত। তার সামনে সাজানো থাকত খাবারের প্লেটও।
এর কিছু দিন পর থেকেই ইউজিনের মধ্যে অদ্ভুত কিছু আচরণ লক্ষ্য করতে শুরু করেন তাঁর বাবা-মা। মাঝে মধ্যেই তাঁরা দেখতেন ইউজিন ওই পুতুলটির সঙ্গে কথা বলছেন। এমন ব্যবহার করতেন, যেন তিনি কোনও মানুষের সঙ্গেই গল্প করছেন। তাঁরা ইউজিন ছাড়া অন্য একটা কণ্ঠস্বরও শুনতে পেতেন বলে দাবি করেছিলেন।
প্রথম প্রথম তাঁরা মনে করতেন ইউজিনই কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে এমন করে কথা বলছেন। কিন্তু তা যে আসলে নয়, খুব তাড়াতাড়ি সেটা বুঝে গিয়েছিলেন। এরপর যতদিন রবার্ট তাঁদের সঙ্গে থেকেছে, অদ্ভুত কিছু ঘটনা লক্ষ্য করতে শুরু করেন তাঁরা।
মাঝেমধ্যে রাতে ছেলের ঘরে আসবাবপত্র ভাঙার আওয়াজ পেতেন তাঁরা। রাতে ঘুম থেকে উঠে তাঁরা ছেলের ঘরে ঢুকে দেখতেন, ছোট ইউজিন ঘরের এক কোণে ভয় মুখে লুকিয়ে রয়েছে। আর রবার্টের দিকে আঙুল দিয়ে বোঝাতে চাইছে, এ সবই তার কাজ।
কিন্তু তা সত্ত্বেও রবার্টকে কখনও দূরে সরিয়ে রাখেনি ইউজিন। পরবর্তীকালে ইউজিন নিউ ইয়র্কে চলে যায় পড়াশোনার জন্য। তিনি একজন একজন লেখক এবং শিল্পী হন। ১৯৩০ সালে প্যারিসে অ্যানিটি পার্কার নামে এক মহিলার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। সেখানেই থাকতে শুরু করেন।
পরে বাবা-মার মৃত্যুর পর বাড়িতে ফিরে এসে দেখেন, রবার্টকে বাড়ির চিলেকোঠায় বন্ধ করে রাখা। স্ত্রী বারবার মানা করা সত্ত্বেও তিনি রবার্টকে সেখান থেকে বার করে আনেন। তাকে একটা ঘরের জানলার পাশে একটা আসনে বসিয়ে রাখেন, যাতে রবার্ট জানলা দিয়ে রাস্তা দেখতে পায়।
তত দিনে রবার্টের অদ্ভুত আচরণের কথা প্রতিবেশীরা সকলেই জেনে ফেলেছিলেন। মাধেমধ্যেই পথচারীরা ইউজিনের কাছে অভিযোগ করতেন যে, পুতুলটিকে এক জানলা থেকে আর এক জানলায় ছুটে বেড়াতে দেখেছেন তাঁরা। এরপর ইউজিন ফের রবার্টকে চিলেকোঠার ঘরে বন্দি করে দেন।
১৯৭৪ সালে ইউজিনের মৃত্যু হয়। রবার্টকে একটা ট্রাঙ্কের মধ্যে ঢুকিয়ে ওই বাড়ির চিলেকোঠাতেই রাখা হয়। ইউজিনের মৃত্যুর দু’বছর পর তাঁর স্ত্রী পার্কারও মারা যান। তাঁদের মৃত্যুর পর বাড়িটাও বিক্রি হয়ে যায়। একটা নতুন পরিবার ওই বাড়িতে থাকতে শুরু করেন।
সেই পরিবারের এক ১০ বছরের মেয়ে একদিন চিলেকোঠার পুরনো ওই ট্রাঙ্ক থেকে রবার্টকে বার করে। তারপর থেকেই নাকি ফের ওই বাড়িতে শুরু হয় রবার্টের দৌরাত্ম্য। ফের রাতে সারা বাড়িতে নাকি দৌড়ে বেড়াতে শুরু করে সে। আসবাবপত্র ভাঙার আওয়াজে মেয়েটির বাবা-মায়েরও ঘুম ভেঙে যেতে শুরু করে।
প্রতিবেশীদের থেকে বিষয়টি শুনে এই পরিবারও রবার্টকে ফের চিলেকোঠায় বন্দি করে রাখে। তারপর থেকে রবার্ট কোনও ক্ষতি করত না। এই নতুন পরিবারটি ২০ বছর ওই বাড়িতেই কাটিয়েছিল। এরপর তাঁরাও বাড়িটি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যান।
ফ্লোরিডায় কি ওয়েস্টের এই বাড়িটি বর্তমানে গেস্ট হাউস। বাড়িটির নতুন মালিক ১৯৯৪ সালে রবার্টকে কি ওয়েস্টের ইস্ট মার্টেলো মিউজিয়ামে দান করে দেন। তারপর থেকে ওই মিউজিয়ামেরই একটি কাচের ঘরে বন্দি রবার্ট।
সারা বছর ধরেই রবার্টের ঘরের সামনে ভিড় জমে থাকে কৌতূহলীদের। অনেকে ছবিও তোলেন। কিন্তু অনেকে মনে করেন, কেউ তার ছবি তুলুক সেটা রবার্ট নাকি একেবারেই পছন্দ করে না। যাঁরা ছবি তুলেছিলেন, তাঁদের অনেকেই মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষকে চিঠিতে তাঁদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কথা জানিয়েছেন।
তাই অনেকেই রবার্টকে ক্ষমা চেয়ে চিঠিও লিখেছিলেন। মিউজিয়ামে রবার্টের ঘরের দেওয়ালে সেই চিঠিগুলো এখনও লাগানো রয়েছে। কেউ কেউ তাকে খুশি করতে ক্যান্ডির বাক্সও উপহার দিয়েছিলেন। রবার্টের এই কাহিনি কতটা সত্যি তা নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। তবে তাতে কিছু আসে যায় না। রবার্টের ঘরের সামনে আজও ভিড় জমে থাকে কৌতূহলীদের।