USA

ফুল ফুটলেও এখনও বসন্ত এল না এই শহরে

৪ মার্চ সিয়্যাটলের অ্যামাজ়ন, মাইক্রোসফ্ট, ফেসবুক, গুগ্‌লের মতো বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলি তাদের কর্মচারীদের বাড়ি থেকে কাজ করার নির্দেশ দেয়।

Advertisement

সুযোগ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

সিয়্যাটল (আমেরিকা) শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২০ ০৮:০৭
Share:

করোনা পরীক্ষার লাইনে দারিয়ে।—ছবি রয়টার্স

আমেরিকার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ওয়াশিংটন প্রদেশের সবচেয়ে জনবহুল শহর সিয়্যাটলকে এই মুহূর্তে আমেরিকার করোনা-সংক্রমণের উপকেন্দ্র বলা হচ্ছে। সিয়্যাটল শহরের জনসংখ্যা প্রায় ৩৫ লক্ষ। চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি মার্কিন মুলুকের এই শহরেই নোভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ঘটনা জনসমক্ষে আসে। প্রায় সেই সময় থেকেই মাইক্রোসফ্ট, অ্যামাজ়ন, স্টারবাক্স ইত্যাদি বড় মাপের সংস্থাগুলি, যাদের প্রধান কার্যালয় এই শহরেই, তারা সতর্ক এবং সচেতন হয়ে যায়। এর প্রায় এক মাস পরে ২৯ ফেব্রুয়ারি সিয়্যাটলের কাছেই কার্কল্যান্ডে ‘লাইফকেয়ার সেন্টারে’ কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত এক প্রবীণ নাগরিকের মৃত্যু ঘোষণা করা হয়। সেটা ছিল আমেরিকায় প্রথম কোভিড-১৯ মৃত্যু। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত শুধু ওয়াশিংটন প্রদেশেই কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫৬৮। ৩৭ জনের মৃত্যুর কথা জানা গিয়েছে।

Advertisement

৪ মার্চ সিয়্যাটলের অ্যামাজ়ন, মাইক্রোসফ্ট, ফেসবুক, গুগ্‌লের মতো বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলি তাদের কর্মচারীদের বাড়ি থেকে কাজ করার নির্দেশ দেয়। কিছু দিনের মধ্যে শহরের বাকি প্রযুক্তি সংস্থাগুলিও সেই পথেই হাঁটছে।

আমি প্রায় ৭ বছর সিয়্যাটল শহরে রয়েছি এবং এখানেই একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করি। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর নির্দেশ পাওয়ার পর থেকে আমিও এখন ‘গৃহবন্দি’। করোনাভাইরাস সংক্রান্ত সমস্ত খবর ও তথ্য ইন্টারনেট থেকে পড়ে নিজেকে ওয়াকিবহাল রাখছি। সব রকম সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বন করছি। হাত ধোয়ার সময়ে বাড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে ২০ সেকেন্ড ধরে দু’বার ‘হ্যাপি বার্থডে’ গাইছি, আতঙ্কিত না হয়ে শান্ত থাকার চেষ্টা করছি। ইউটিউবে করোনাভাইরাস থেকে ইবোলা-র সমস্ত

Advertisement

রকম তথ্যচিত্র ও ভিডিয়ো দেখে ফেলেছি। পরিবার ও বন্ধুদের সকলের সাথে ফোন, ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপেই যোগাযোগ রাখছি।

এখন আমার দৈনন্দিন রুটিন হল— রোজ সকালে উঠে নিম্নগামী স্টক মার্কেটের রিপোর্ট দেখে দীর্ঘশাস ফেলা, ল্যাপটপ থেকে ওয়ার্কস্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ শুরু করা, ল্যাপটপে ভিডিয়ো কনফারেন্সিং করে সহকর্মীদের সঙ্গে মিটিং করা ইত্যাদি। রান্না আপাতত বাড়িতেই করছি, বাইরে থেকে খেতে ইচ্ছা হলে কোনো রেস্তরাঁ থেকে টেক আউট অর্ডার করে নিচ্ছি। আর বাকি সময় নেটফ্লিক্স বা প্রাইম ভিডিয়োয় ওয়েব সিরিজ দেখে সময় কেটে যাচ্ছে। সপ্তাহের শেষে কোনও বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে দিয়ে মেজাজ ভাল করে নিচ্ছি।

সিয়্যাটল-এর কোভিড-১৯-এর পরিস্থিতির উপরে কিছু লিখতে গিয়ে ভাবলাম একবার সিয়্যাটল ডাউনটাউন এলাকা ঘুরে আসি। আমার বাড়ি থেকে সিয়্যাটল ডাউনটাউন যেতে কাজের দিনে সাধারণত অত্যধিক যান চলাচল-এর জন্য এক ঘণ্টা বা তার বেশি লাগে। আজকে সেটা লাগল মাত্র ২০ মিনিট। আই-৫ হাইওয়েতে সাধারণত আটটি লেনই সম্পূর্ণ ভর্তি থাকে, আজ সেখানে অনেক কম গাড়ি চলছে। সাউথ লেক ইউনিয়ন আর ডাউনটাউনের অফিস পাড়া আজ প্রায় ফাঁকা। যে কোনও সাধারণ একটা দিনে সিয়্যাটলে পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র পাইক প্লেস মার্কেট স্থানীয় বাসিন্দা এবং পর্যটকদের ভিড়ে জমজমাট থাকে। আজ সেখানে মাছ, ফল, আনাজের বাজারে কোনও ক্রেতা নেই। সিয়্যাটলের ল্যান্ডমার্ক ‘স্পেস নিডল’-এর তলা থেকে অন্য দিনের মতো কোনো স্ট্রিট মিউজিকের শব্দ ভেসে আসছে না। আমার প্রিয় রেস্তরাঁগুলোও এখন ফাঁকা।

পুরো শহর এখনও লক ডাউন হয়নি। তবে ৩১ মার্চ পর্যন্ত কাছের তিনটি কাউন্টিতে পঞ্চাশ জনের বেশি জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন আমাদের প্রদেশের গভর্নর। সিয়্যাটলের কিং কাউন্টির সমস্ত স্কুল অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের সব ক্লাস অনলাইনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা চাপা আতঙ্ক আছে। আমার এক বন্ধুর পাঠানো ছবিতে দেখলাম, বিখ্যাত হোলসেলার সংস্থা কস্টকোর একটি শাখার বাইরে অনেক লম্বা লাইন, সবাই দৈনন্দিন জীবনের দরকারি সামগ্রী সঞ্চয় করে রাখতে চাইছেন। টয়লেট পেপার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার আর ফেসমাস্ক কোনও দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। বাকি দোকান গুলিতে দেখলাম ডিসইনফেক্ট্যান্ট আর টিন ফুডের খাবারের তাকগুলি সম্পূর্ণ খালি। ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং’ বা সামাজিক মাধ্যমের এর সাথে স্থানীয় ব্যাবসাগুলিও মানিয়ে নিচ্ছে। এএমসি সিনেমা হলে প্রতি শোয়ের অর্ধেক টিকিট বিক্রি করছে, যাতে দর্শক সংখ্যা অনেক কম হয়। ‘ডোরড্যাশ’ এবং ‘উবর ইটস’-এর মতো ফুড ডেলিভারি অ্যাপ নতুন ফিচার যোগ করছে— ‘নো কন্টাক্ট ডেলিভারি’। বাড়ি থেকে কাজের জন্য লোকজন বেশি ইন্টারনেট ব্যাবহার করছে, তাই ইন্টারনেট প্রোভাইডার কমকাস্ট মাসিক ইন্টারনেট এর ‘ডেটা ক্যাপ’ বা ইন্টারনেটের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দিয়েছে।

এখন সিয়্যাটলে বসন্ত। পাহাড়, হ্রদ আর ঘন সবুজ গাছপালায় ঘেরা এই শহরটি এই সময়ে আরও অপরূপ হয়ে ওঠে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের জন্য এ সময়টা আমার খুব প্রিয়। আজ দিনটা খুব ঝকঝকে। বাইরে মৃদু-মন্দ হাওয়া দিচ্ছে। বাড়ির সামনের গাছের পাতায় কাঁচা-মিঠে রোদ খেলা করছে।

আকাশ আর হ্রদ দুই-ই স্বচ্ছ নীল। দূরে বরফ ঢাকা ক্যাসকেড, অলিম্পিক আর মাউন্ট রাইনিয়ের পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছে। অন্য যে কোনও সময়ে এমন দিনে সিয়্যাটলের বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে রাস্তায় হাজার হাজার লোক দেখা যেত। হ্রদের ধারে অনেকে জগিং

এবং বাইকিং করতেন। কিন্তু এই বছর এই শহর বড় নির্জন, খুব বেশি নিস্তব্ধ। তাই ফুল ফুটলেও এ শহরে এখনও বসন্ত এল না।

লেখক অ্যামাজ়ন সংস্থার ইঞ্জিনিয়র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement