অক্ষর জ্ঞান হওয়ার পরেই শিখেছিলাম “জল পড়ে, পাতা নড়ে”। এটাও শিখেছিলাম “জলের অপর নাম জীবন”! সভ্য মানবজাতি ছোটবেলার প্রাথমিক জ্ঞানটাই ভুলে গেল। আজ জলসঙ্কট গোটা বিশ্বে এতটাই ভয়াবহ যে, অদূর ভবিষ্যতে এই জলের জন্যই না তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়!
কাজের সূত্রে গত তিন বছর দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে রয়েছি। হ্যাঁ, সেই কেপ টাউন, যেখানকার জলসঙ্কটের খবর ও ভিডিয়ো গত বছর থেকে টিভি চ্যানেল ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। অথচ মাত্র তিন-চার মাসের লড়াইয়ে কেপ টাউন পুরসভা সাধারণ মানুষের সচেতনতা আর সহায়তাকে হাতিয়ার করে কী ভাবে সেই প্রাথমিক বিপর্যয়কে কাটিয়ে উঠল, তা নিয়ে তেমন হইচই চোখে পড়েনি।
কেপ টাউন শহরের অদূরে পাহাড়ের কোলে ছ’টি বিশালাকার জলাশয়ে বাঁধ দিয়ে জলসঞ্চয় করা হয়। এই সঞ্চিত জলই শহরবাসীর ব্যবহৃত জলের উৎস। ভূগর্ভস্থ জল এখানে ব্যবহার হয় না বললেই চলে। জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে ২০১৮-র আগের তিন বছর কেপ টাউন-সহ পুরো পশ্চিম কেপ প্রদেশেই বৃষ্টি হয়েছিল নামমাত্র। শহরবাসীর দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো ও ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে ২০১৮-র জানুয়ারি মাসে এসে বোঝা গেল, জলের ভাঁড়ারে রীতিমতো টান পড়েছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে কেপ টাউন পুরসভা ঘোষণা
করল, জলসঙ্কট এমনই তীব্র আকার নিয়েছে যে, তিন মাস পরে কেপ টাউনবাসীকে তারা আর জল সরবরাহ করতে পারবে না। ১২ই মে, ২০১৮ দিনটিকে চিহ্নিত করা হল ‘ডে-জ়িরো’ হিসেবে। অর্থাৎ ওই দিনের পরে শহরের কোনও কল থেকে আর জল পড়বে না। গোটা বিশ্ব এই খবরে স্তব্ধিত, কেপটাউনবাসী বিভ্রান্ত ও সন্ত্রস্ত— এর পরে কী হবে?
আমার মতো বিদেশিরা, যারা কর্মসূত্রে এই শহরের বাসিন্দা, তারা ভাবতে শুরু করলাম এই শহর, এই দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। এমন পরিস্থিতি এলে তো গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী! গ্রীষ্মের সৌন্দর্যের টানে এই সময় হাজার হাজার পর্যটক আসেন এই শহরে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে এই শহর ‘মাদার সিটি’ নামেও পরিচিত। তিন দিক সমুদ্রে ঘেরা সেই মাদার সিটি-ই কি না শেষে জলের অভাবে ধ্বংসের পথে! কেন এই পরিস্থিতি? এত দিন কী করছিল সরকার? সকলের মতো আমার মনেও এই প্রশ্ন। উত্তর খুঁজতে গিয়ে জড়িয়ে পড়লাম জলসঙ্কট থেকে মুক্তির লড়াইয়ে।
সরকার ও পুরসভা প্রথমেই বুঝে গেল, সাধারণ মানুষের সাহায্য ছাড়া জলসঙ্কটের মোকাবিলা করা অসম্ভব। আইন নয়, সচেতনতাই হবে এই লড়াইয়ের প্রধান হাতিয়ার। পুরসভা হিসেব করে বলল, প্রত্যেক শহরবাসীকে দৈনিক জলের ব্যবহার ৫০ লিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। কী ভাবে, তারও একটা গাইডলাইন বানানো হল জনগণের সুবিধার্থে। এই গাইডলাইন পোস্টারের আকারে ছড়িয়ে পড়ল রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, অফিস, দোকানপাট, শপিংমল সর্বত্র। প্রতি ১০-১৫ মিনিট অন্তর এফএম রেডিও, টেলিভিশনে সচেতনতা-প্রচার চলতে থাকল। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা হল খুব সচেতন ভাবে, যাতে অহেতুক গুজব না ছড়ায়। এগিয়ে এল যুবসমাজ, তারা নিয়ে এল নতুন ট্যাগলাইন– ‘#ওয়াটারওয়াইজ়’, অর্থাৎ ‘জলজ্ঞানী’। কে কী ভাবে ‘জলজ্ঞানী’ হয়ে কতটা জল বাঁচাতে পারে, সেই সব ধ্যান-ধারণা ছড়িয়ে পড়তে লাগল সোশ্যাল মিডিয়ায়।
(সোমবার পরের কিস্তি প্রকাশিত হবে)
লেখক কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিনাল কেমিস্ট্রি ও ড্রাগ ডিসকভারি নিয়ে গবেষণারত