বাণিজ্যিক ভাবে দ্বার খোলার আগে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক এর আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন, পরে তিনি বলেছিলেন, এই হোটেল বিশ্বের অন্য সব হোটেলের তুলনায় এগিয়ে। তাই এটা ‘সেভেন স্টার হোটেল’। তার পর থেকে দুবাইয়ের ‘বুর্জ আল আরব’-এর গায়ে সাতটি তারার আলো।
‘বুর্জ’ কথার অর্থ মিনার। ‘বুর্জ আল আরব’ হল আরবদেশের মিনার। দুবাইয়ে পারস্য উপসাগরের উপকূলে ‘জুমেইরাহ’ হল সাদা বালির সৈকত। সেখানে একটি কৃত্রিম দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছে এই হোটেল। পালতোলা নৌকোর মতো দেখতে এই অতিথিশালা বিশ্বের উচ্চতম হোটেলগুলির মধ্যে অন্যতম।
৫ বছর ধরে নির্মাণপর্বের পরে ১৯৯৯ সালে খুলে যায় বুর্জ আল আরবের দরজা। কৃত্রিম দ্বীপের উপর তৈরি করা হয়েছে বলেই সম্পূর্ণ নির্মাণ প্রক্রিয়া শেষ হতে এত সময় লেগে যায়। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এর যোগাযোগ থাকে একটি সেতুর মাধ্যমে। তবে বিলাসবহুল হোটেলের নিজস্ব এই সেতু ব্যবহার করতে পারেন শুধুমাত্র হোটেলের কর্মী ও অতিথিরা।
৬৮৯ ফুট উচ্চতার এই হোটেলের ছাদের কাছে আছে নিজস্ব হেলিপ্যাড। দুবাই বিমানবন্দর থেকে অতিথিদের হেলিকপ্টারে উড়িয়ে আনেন হোটেল কর্তৃপক্ষ। যদি কেউ সড়কপথে আসতে চায়, তা হলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রোলস রয়েস।
হোটেলের ভিতের পা রাখলেই চোখ ধাঁধিঁয়ে যায় সোনার ছটায়। অন্দরসজ্জা, ঝাড়বাতি থেকে আসবাবপত্র— সব কিছুতেই খাঁটি সোনার উজ্জ্বল উপস্থিতি। হোটেলের সাজসজ্জার মধ্যে ২২ হাজার বর্গফুটেরও বেশি জায়গা জুড়ে সোনার হাজিরা। আয়নার ফ্রেম থেকে টেলিভিশনের বর্ডার— মুখ ঢেকেছে ২৪ ক্যারেট সোনার প্রলেপে।
হোটেলে বিলাসবহুল স্যুট ২০২টি। তার মধ্যে কয়েকটি থেকে পর্যটকরা দেখতে পাবেন ‘পাম জুমেইরা’-র দৃশ্য। খেজুর গাছের মতো আকারবিশিষ্ট ‘পাম জুমেইরা’ হল কিছু কৃত্রিম দ্বীপের সমষ্টি। বিলাসবহুল হোটেল, শপিং কমপ্লেক্স-সহ এই অংশ হল দুবাই তথা বিশ্বের বিত্তবানদের অন্যতম ঠিকানা।
প্রতিটা স্যুইটের জন্য থাকেন একজন করে নির্দিষ্ট বাটলার। ওই স্যুইটের বাসিন্দাদের জন্য তিনি নিযুক্ত হন। অতিথিদের অভিবাদন জানিয়ে তিনি তাঁদের হোটেলের দরজা থেকে নিয়ে যান স্যুইট অবধি। এই হোটেলের সাজসজ্জা ও রীতিনীতিতে মরু সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট। তবে হোটেল নির্মাণে অনুসরণ করা হয়েছে গ্রিক স্থাপত্যও।
আগুন, বাতাস, মাটি এবং জল— প্রকৃতির এই মূল উপাদানের প্রভাব রয়েছে স্যুইটগুলির ভিতরের রঙে। সবথেকে ছোট স্যুইটের আয়তনও ১,৮৩০ বর্গফুট। একটা স্যুইট সম্পূর্ণ ঘুরে দেখতেও সময় লাগে অন্তত ৩০ মিনিট।
হোটেলের রয়্যাল স্যুটগুলি তৈরি হয়েছে একটি আস্ত ফ্লোর জুড়ে। এ রকম একটি স্যুইটের আয়তন প্রায় ৮ হাজার ৪০০ বর্গফুট। রাজকীয় এই স্যুইটের মাঝে থাকে বিশাল পালঙ্ক। খাঁটি মিশরীয় সুতির চাদর বিছিয়ে থাকা পালঙ্কের উপর সিলিং জুড়ে বিরাজ করে বিশাল আয়না। অতিথির আরামদায়ক ঘুমের জন্য হোটেল থেকে দেওয়া হয় ১৭ রকমের বালিশ।
হোটেলের ১৮তম তলায় আছে স্পা। পারস্য উপসাগরের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সেখানে বুঁদ হয়ে থাকা যায় স্পা-এর আরামে। পাশাপাশি হোটেলে আছে একাধিক ইন্ডোর ও আউটডোর সুইমিং পুল। শুধুমাত্র মহিলা ও শিশুদের জন্য আছে আলাদা সুইমিং পুল।
যুগলদের জন্য নির্দিষ্ট ইন্ডোর সুইমিং পুলে আছে চাঁদের আলোয় সাঁতার কাটার ব্যবস্থা। যদি এতেও মন না ভরে, রয়েছে হোটেলের ব্যক্তিগত সৈকত। সেখানেও পর্যটকের জন্য হাজির হরেক বিলাস।
এই হোটেলের ৬টি রেস্তরাঁয় সাজানো আছে বিশ্বের নানা প্রান্তের খাবার। সেগুলির মধ্যে সবথেকে আকর্ষণীয় হল ‘গোল্ড অন ২৭’। ‘বুর্জ আল আরব’-এর ২৭তম ফ্লোরে এই বার সোনা দিয়ে সাজানো। বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত বারটেন্ডাররা তৈরি করেন বিশেষ পানীয়, যার রেসিপি গোপন রাখা হয়। বিশেষ রকমের পানীয় তৈরিতে আঙুর রসের সঙ্গে মেশানো হয় সোনার গুঁড়োও।
বুর্জ আল আরব-এর রেস্তঁরাগুলির মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় হল ‘আল মুনটাহা’ এবং ‘আল মাহারা’। বিভিন্ন নামী পত্রিকার প্রচ্ছদ থেকে হলিউডের সিনেমায় জায়গা করে নিয়েছে ‘বুর্জ আল আরব’।
আমেরিকার এক সংবাদসংস্থার তালিকা অনুযায়ী বিশ্বের প্রথম ১৫টি মহার্ঘ্য হোটেলের মধ্যে বুর্জ আল আরব আছে ১২ নম্বরে। এই হোটেলে দু’জনের এক রাত কাটানোর ন্যূনতম খরচ প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। ডুপ্লে স্যুইটগুলিতে ১ রাত কাটানোর খরচ ৮ লক্ষ টাকারও বেশি।
তবে তাদের ৭ তারা পরিচয় নিয়ে বিতর্কও আছে। বিশ্বের আরও কিছু হোটেলের গায়ে এই পরিচয় আছে। সাত তারা হোটেলের কোনও নির্দিষ্ট মাপকাঠি না থাকায় এই দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যায়। তবে বুর্জ আল আরব-এর তরফে কোনও দিন নিজেদের ‘সাততারা হোটেল’ হিসেবে দাবি করা হয় না। সে ভাবে বিজ্ঞাপিতও করা হয় না। তবে এই হোটেল আপাতত দুবাইয়ের প্রতীক।