কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। —ফাইল চিত্র।
তিনি থাকেন উত্তর তাইল্যান্ডে। কিন্তু ঠিক কোথায় তা বলবেন না মায়ানমারের দেশছাড়া যুবক। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মায়ানমারের ‘ভাঙা স্বপ্ন’ (ব্রোকেন ড্রিমস) প্রদর্শনের পরে রবীন্দ্রসদনের সাজঘরে বো তেট ঠোন বললেন, “আমার পরিবারের বিষয়েও কিচ্ছু বলা যাবে না। কারণ ওরা জীবনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আমি নিজেও পুরোপুরি নিরাপদ, বলতে পারছি না!”
ভাঙা স্বপ্ন আসলে ন’টি ছোট ছোট ছবির মিশেল। কিন্তু সামরিক অভ্যূত্থান পরবর্তী মায়ানমারে শোষণ, আতঙ্ক, মানসিক আঘাত, স্বজন বিয়োগ, শাসকের নিষ্ঠুরতা, স্বপ্ন, প্রতিরোধের আখ্যানে স্তব্ধ হয়ে মনে হয় যেন একটি ছবিই হয়ে চলেছে। ন’জন পরিচালকের এক জন হলেন বো। মায়ানমার বা মায়ানমারের বাইরে ছড়িয়ে থাকা অন্য পরিচালকদের বর্তমান ঠিকানাও গোপনীয়। রবিবার রবীন্দ্রসদনে শোয়ের সময়ে সেই বন্ধুদের জন্যই বড় পর্দার ছবি তুলছিলেন বো।
মায়ানমারের ঐতিহ্যমাখা শার্ট এবং ডোরাকাটা 'লোঙ্গি'তে সেজে শোয়ের আগেও তিনি বলছিলেন, “এর মধ্যে আমাদের কলজের টুকরো দেখতে পাবেন!” মায়ানমার কী ভাবে বেঁচে আছে, তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে দেখল কলকাতা। এবং এমন একটা ছবি দেখল, যার শিল্পী, কলাকুশলীরা সকলেই দেশছাড়া নয়তো গা-ঢাকা দিয়ে আছেন। গত বছরই এই পরিচালকেরা 'মায়ানমার ডায়েরিজ়' নামে একটি ছবি করেছিলেন। তা বার্লিনে পুরস্কৃত। ওই সাফল্যের সাহস পুঁজি করেই ফের বহু কাঠখড় পুড়িয়ে চেষ্টা। গত মাসে ব্যাঙ্ককে বিভিন্ন দূতাবাস, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার সংগঠনের সামনে ছবিটি দেখানো হয়েছে। এর পরেই কলকাতায় আসা।
২০২১এর ফেব্রুয়ারির কয়েক মাস বাদে নভেম্বরে দেশ ছেড়েছেন বো। স্বাধীন চলচ্চিত্র পরিচালক ৩৫ বছরের বোয়ের এটি দ্বিতীয় পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি। বোয়ের ছবিটি মায়ানমারের সীমান্ত এলাকায় সাধারণ ঘরছাড়াদের দিয়ে অভিনীত। তবে অন্য পরিচালক তো বটেই অভিনেতা, অভিনেত্রীরা অনেকেই মায়ানমারে তারকা। এক জন নামী গায়িকা জেলে নির্যাতিতা একটি মেয়ের আতঙ্ক পরবর্তী মানসিক বৈকল্য বা পোস্ট-ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার-এর অবস্থা মেলে ধরেছেন। এক প্রতিবাদী ছাত্রীর চরিত্রে মায়ানমারের জনপ্রিয় নায়িকা। সামরিক জুন্টা বিরোধী বিপ্লবীদের সংশয়, অন্তর্দ্বন্দ্ব সব অকপটে তুলে ধরে ছবিটি। বো বলেন, “আমরাও মানুষ। আমাদেরও কখনও হতাশ লাগে। একটু দম ফেলতে, স্বার্থপরের মতো বাঁচতেও ইচ্ছে করে। কিন্তু পর ক্ষণে ভাবি, হাল ছাড়লে চলবে না। এ লড়াইয়ের শেষ দেখেই ছাড়ব!” রোহিঙ্গাদের সমস্যা নিয়েও সমব্যথী বো। বললেন, “ওঁরা তো সামরিক শাসনের আগে থেকেই ভুগছেন।”
রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাবেই মায়ানমারে ২০ লক্ষের বেশি বাসিন্দা দেশছাড়া। বোয়ের দাবি, “জুন্টার সেনাবাহিনীর অনেকেই ক্রমশ বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে। ওরাও একনায়কতন্ত্র নিতে পারছে না।”
গত জানুয়ারিতে কলকাতায় পিপলস ফিল্ম কালেক্টিভ বলে একটি গোষ্ঠীর তথ্যচিত্র উৎসবেও ‘জার্নি অব আ বার্ড’ বলে মায়ানমারের একটি ছবি দেখে কলকাতা। ২৪ বছরের পরিচালক, তাঁর বন্ধুদের প্রতিবাদ আন্দোলন নিয়েই ছবি। তাতে কারও নাম ছিল না। ওই ছবির পরিচালকও বোয়ের বন্ধু। কাল, মঙ্গলবার বিকেলে নজরুলতীর্থ-২ প্রেক্ষাগৃহে ফের ‘ব্রোকেন ড্রিমস’ দেখানোর কথা। কলকাতার ভালবাসায় অনেকটা লড়ার রসদ নিতে পারার কথাই বলে গেলেন বো।