Bacterial Diseases

ইউক্রেনের যুদ্ধে বাঙালির জৈব-ব্যান্ডেজ

চন্দন জানাচ্ছেন, মানুষের দেহরস, রক্ত, লালা ইত্যাদি সব কিছুতেই আয়ন রয়েছে। অর্থাৎ তা বিদ্যুতের পরিবাহী। ব্যাকটিরিয়া আয়ন আদানপ্রদান করেই বৈদ্যুতিক সঙ্কেতের মাধ্যমে অ্যাগ্রিগেট তৈরি করছে, অর্থাৎ ‘জোট’ বাঁধছে।

Advertisement

সুজিষ্ণু মাহাতো

শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪ ০৬:১২
Share:

— প্রতীকী চিত্র।

‘দূরত্ব বাড়ে যোগাযোগ নিভে যায়’। জনপ্রিয় বাংলা গানের মতোই ব্যাকটিরিয়াদের দূরত্ব বাড়িয়ে তাদের যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া। তাদের ‘বোবা’ করে দেওয়া, যাতে তারা একে অন্যের সঙ্গে জোট বাঁধতে না পারে। কার্যত এই পদ্ধতিতেই সংক্রমণজনিত জটিলতার চিকিৎসায় দিশা দেখাচ্ছে জৈব-বৈদ্যুতিক ব্যান্ডেজ বা বায়ো ইলেকট্রিক ব্যান্ডেজ। নেপথ্যে বাংলার ভূমিপুত্র, আমেরিকা নিবাসী বিজ্ঞানী চন্দনকুমার সেন।

Advertisement

আমেরিকার পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের শল্যচিকিৎসার অধ্যাপক তথা সহ-উপাচার্য চন্দনের নেতৃত্বেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা তৈরি করেছেন সেই ব্যান্ডেজ। আমেরিকায় ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ছাড়পত্র পাওয়ার পরে এ বার সেই ব্যান্ডেজের পরীক্ষা হতে চলেছে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে। আমেরিকার সামরিক বিভাগের উদ্যোগে আর্থিক অনুদান পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক-দল সেই কাজ শুরু করতে চলেছে।

এই প্রকল্পের মুখ্য গবেষক চন্দন জানাচ্ছেন, অঙ্গহানি এবং রক্তে সংক্রমণ বা সেপসিস জনিত মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক কমিয়ে দিতে পারে এই ব্যান্ডেজ। সেই সঙ্গেই তিনি বলছেন, ‘‘আমাদের কাজ যুদ্ধের জন্য নয়। কোনও দেশের পক্ষে বাবিপক্ষে নয়। আমাদের লক্ষ্য মানুষের প্রাণ বাঁচানো।’’

Advertisement

কী ভাবে কাজ করে এই ব্যান্ডেজ? চন্দন জানাচ্ছেন, এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আগে বোঝা দরকার ব্যাকটিরিয়া কী ভাবে মানবদেহে সংক্রমণ ঘটায়। তিনি জানাচ্ছেন, ব্যাকটিরিয়া প্রকৃতিগত ভাবে প্ল্যাঙ্কটনিক, অর্থাৎ জলীয় পদার্থ বা মানবদেহের ক্ষেত্রে দেহরসে ভাসমান থাকে। একা একাই তারা ভেসে বেড়ায় এবং সংক্রমণ ঘটায় সুযোগ পেলেই। কিন্তু গত প্রায় এক দশক ধরে বেশির ভাগ সংক্রমণের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, লক্ষ লক্ষ ব্যাকটিরিয়া এবং রোগগত জীবাণু ‘দল বেঁধে’ জটলা অর্থাৎ অ্যাগ্রিগেট তৈরি করছে। এই জোট তারা বাঁধতে পারছে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। সেই যোগাযোগ তারা করছে দেহরসে বৈদ্যুতিক সঙ্কেতের মাধ্যমে।

চন্দন জানাচ্ছেন, মানুষের দেহরস, রক্ত, লালা ইত্যাদি সব কিছুতেই আয়ন রয়েছে। অর্থাৎ তা বিদ্যুতের পরিবাহী। ব্যাকটিরিয়া আয়ন আদানপ্রদান করেই বৈদ্যুতিক সঙ্কেতের মাধ্যমে অ্যাগ্রিগেট তৈরি করছে, অর্থাৎ ‘জোট’ বাঁধছে। ব্যাক্টিরিয়ার এই জোটই হচ্ছে ‘বায়োফিল্ম’, যার রোগগত প্রভাব আটকাতে পারে না কোনও অ্যান্টিবায়োটিক। কারণ, ব্যাক্টিরিয়ার এমনিতেই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার জিনগত ক্ষমতা থাকে। আর কোটি কোটি ব্যাক্টিরিয়ার জোট সেই ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে তুলছে। ফলে, কাজ করছে না ওষুধ। যুদ্ধক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও ভয়ঙ্কর। কারণ, সেই ক্ষতস্থানে মিশে থাকছে ধুলো, গাছগাছালির কণা, যেগুলির মাধ্যমেও প্রচুর ব্যাক্টিরিয়া ঢুকছে বাইরে থেকে। ফলে সংক্রমণ না থামায় আহত সৈন্যদের বাদ যাচ্ছে হাত, পা।

ব্যাক্টিরিয়ার জোট বাঁধার প্রক্রিয়াকেই থামিয়ে দিচ্ছে চন্দনদের তৈরি ব্যান্ডেজ। চন্দন বলছেন, ‘‘যে কোনও জীবিত বস্তুর জৈব রাসায়নিক দিক আছে, আর জৈব পদার্থবিদ্যার দিক থাকে। সাধারণত ওষুধ তৈরির সময় তার রাসায়নিক বা জৈব রাসায়নিক দিকটিকেই মাথায় রাখা হয়, পদার্থবিদ্যার দিকটি নয়। এ ক্ষেত্রে জীবিত বস্তু হিসেবে যে ব্যাকটিরিয়ার পদার্থবিদ্যার দিক বা সেই প্রকৃতিকে ব্যবহার করে তাকে নিবারণ করা হচ্ছে। এটা একটা নতুন ব্যাপার।’’

চন্দন জানাচ্ছেন, ব্যাক্টিরিয়া এবং অন্যান্য রোগগত জীবাণুর জোট বাঁধার পদ্ধতি জৈব-বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়া। চন্দনের কথায়, ‘‘সে কারণেই মনে হয়েছিল, কোনও ভাবে যদি ব্যাক্টিরিয়ার মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া যায়, তা হলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ফলে, জীবাণুগত ও রোগগত প্রক্রিয়া ও প্রভাব ঠেকানো যাবে।’’ জৈব-বৈদ্যুতিক ব্যান্ডেজ ঠিক সেটাই করছে। চন্দন জানান, এই ব্যান্ডেজ পলিয়েস্টার কাপড়ের তৈরি, যা জুড়ে নির্দিষ্ট নকশায় দস্তা ও রুপোর অসংখ্য বিন্দু রয়েছে। সেই ব্যান্ডেজ ক্ষতস্থানে দিলেই সেটিতে দেহরস বা রক্ত লাগবে, তখন সেখানে তৈরি হবে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র। চন্দন বলছেন, ‘‘সেই বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র ব্যাক্টিরিয়াদের তৈরি বৈদ্যুতিক বার্তালাপে বিঘ্ন ঘটাবে। তাই তারা জোট বেঁধে বায়োফিল্মতৈরি করতে পারবে না। যদিও বা বায়োফিল্ম তৈরি হয়ে থাকে, সেই জোট ভেঙে যাবে।’’

চন্দন জানান, তাঁদের এই ব্যান্ডেজ আমেরিকার খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (এফডিএ) ছাড়পত্র পেয়ে বাজারে বিক্রিও হচ্ছে। আমেরিকার সেনাও এই ব্যান্ডেজ পরীক্ষা করেছে। সেখানে ফল ইতিবাচক। তাই একেবারে যুদ্ধক্ষেত্রে পরীক্ষার কাজে নেমেছেন তাঁরা। চন্দনের কথায়, ‘‘বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে যে চিকিৎসা হয়, তা হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক বা স্নায়ুর চিকিৎসার ক্ষেত্রে নতুন নয়। তবে সংক্রমণের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই বিজ্ঞানকে কাজে লাগানোনতুন পদক্ষেপ।’’

চন্দনের ছোটবেলা কেটেছে হুগলির ব্যান্ডেলে। বাবা চাকরি করতেন কাঁকিনাড়া জুটমিলে। চন্দননগরের শ্রীঅরবিন্দ বিদ্যামন্দির থেকে মাধ্যমিক ও হুগলি কলেজিয়েট স্কুল থেকে উচ্চ-মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হন। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে শারীরবিদ্যায় স্নাতক। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়-বার্কলেতে পোস্ট-ডক্টরেট, তার পরে লরেন্স বার্কলে জাতীয় গবেষণাগারে যোগ দেন।

আমেরিকার ‘ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ ইনভেন্টরস’-এর নির্বাচিত ফেলো চন্দন জানাচ্ছেন, তাঁর গবেষক দলের সদস্য, পোস্ট ডক্টরেট ফেলো ভাসিল পাসতুখ ইউক্রেনের বাসিন্দা। গবেষক দলে রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শল্যচিকিৎসার অধ্যাপক শাশ্বতী রায়, সহকারী অধ্যাপক শমিতা স্টেনার, মেডিসিনের অধ্যাপক রোনাল্ড পোরোপাটিচ। চন্দন-সহ সকলেই পোল্যান্ডে যাবেন। পাসতুখ ইউক্রেনের নাগরিক বলে সে দেশে তাঁর প্রবেশাধিকার রয়েছে। তিনি সেখানে ইউক্রেনের সেনা, চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। বাকিরা পোল্যান্ডে থেকেই কাজ করবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement