বেকারত্ব ভারতের দীর্ঘ দিনের সমস্যা। এ দেশের বহু যুবক-যুবতীই পছন্দমাফিক চাকরি পান না। শিক্ষাজীবন শেষ করে পুরোপুরি ঘরে বসে থাকা তরুণ-তরুণীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বর্তমানে এই একই সমস্যায় ভুগছে আমেরিকা। আটলান্টিকের পারের দেশটিতে এমবিএ পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের কাজ পেতে রীতিমতো কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে বলে প্রকাশ্যে এসেছে চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট।
সম্প্রতি চাকরি না পাওয়ার সমস্যা নিয়ে একটি তথ্যপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় সংবাদ সংস্থা ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’। সেখানে বলা হয়েছে, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড এবং ওয়ার্টনের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্তেরাও কাজ পাচ্ছেন না। ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছর হার্ভার্ড বিজ়নেস স্কুলের এমবিএ স্নাতকদের ২৩ শতাংশ পড়াশোনা শেষ করার তিন মাস পরেও চাকরি পাননি। ২০২২ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ১০ শতাংশ। কিন্তু ২০২৩ সালে এক লাফে সেটি বেড়ে ২০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছয়।
গত কয়েক বছরে ভারতের আইআইটি স্নাতকদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেড়েছে। এ দেশের পরিস্থিতির সঙ্গে আমেরিকায় চাকরির ‘আকাল’-এর বেশ মিল আছে। অন্য দিকে বিশ্বের বেকারত্ব নিয়ে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজ়েশন বা আইএলও)।
আইএলও প্রকাশিত ‘গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ ২০২৪’ শীর্ষক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে সারা দুনিয়ার তরুণ শ্রমশক্তির ১৩ শতাংশ কোনও কাজ পাননি। অর্থাৎ, বিশ্ব জুড়ে মোট বেকার যুবক-যুবতীর সংখ্যা ছিল ৬.৪৯ কোটি।
২০২০ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্টে আবার দাবি করা হয়, প্রতি চার জন পেশাদারের মধ্যে এক জন চাকরি পাচ্ছেন। পরবর্তী পাঁচ বছরে সেই পরিস্থিতির যে খুব একটা বদল হয়েছে, এমন নয়। বিষয়টি নিয়ে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর কাছে মুখ খুলেছেন হার্ভার্ড বিজ়নেস স্কুলের কেরিয়ার ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অ্যালামনি রিলেশনসের অধ্যক্ষ ক্রিস্টেন ফিটজ়প্যাট্রিক।
ক্রিস্টেন বলেছেন, ‘‘চাকরির বাজার যে দুর্দান্ত ভাল, তা একেবারেই বলা যাবে না। এখন আর সঠিক দক্ষতা থাকলেই কাজ পাওয়া যাচ্ছে, এমনটা নয়। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে হার্ভার্ডের ছাত্র বা ছাত্রীদের আলাদা নজরে দেখার ব্যাপারে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে না অনেক নামীদামি সংস্থা।’’
হার্ভার্ডকে বাদ দিলে ওয়ার্টন এবং স্ট্যানফোর্ডের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা চাকরি না পাওয়া এমবিএ পড়ুয়ার সংখ্যা যথাক্রমে ২০ এবং ২২ শতাংশ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’। এ ছাড়া নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ন স্কুল অফ বিজ়নেসের স্নাতকদের মধ্যে প্লেসমেন্টের সংখ্যা ক্রমশ কমছে বলে জানা গিয়েছে।
প্রসঙ্গত, আমেরিকার অন্যান্য নামীদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়াদেরও চাকরি পাওয়া দিন দিন কঠিন হচ্ছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বুথ স্কুল এবং নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেলগ স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টে বেকার স্নাতকদের সংখ্যা তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্নাতকের ডিগ্রি পাওয়ার তিন মাস পরেও চাকরি পাননি কেলগের ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।
‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ জানিয়েছে, হঠাৎ করে কাজের বাজার খারাপ হওয়ায় দ্বিমুখী সমস্যায় ভুগছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমত, এর জন্য ধীরে ধীরে আর্থিক মন্দার কবলে পড়ছে দেশ। দ্বিতীয়ত, যুব সমাজের একটি বড় অংশকে গ্রাস করছে মানসিক সমস্যা।
আমেরিকায় একজন এমবিএ স্নাতক চাকরি জীবনের শুরুতেই উচ্চ বেতন পেয়ে থাকেন। তাঁদের গড় প্রারম্ভিক বেতন ১.৭৫ লক্ষ ডলার বলে জানা গিয়েছে। এ-হেন লোভনীয় চাকরির বাজার খারাপ হওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি সংস্থাগুলি কর্মী হ্রাস করছে। ফলে নামীদামি প্রতিষ্ঠানের এমবিএ স্নাতকেরা পাচ্ছেন না চাকরি।
২০২৩ সালে বিপুল সংখ্যায় কর্মী ছাঁটাই করে গুগ্ল, মাইক্রোসফ্ট, ম্যাককিনসে এবং বিসিজির মতো আমেরিকার বহুজাতিক টেক জায়ান্ট সংস্থা। একই রাস্তায় হেঁটেছে ইকমার্স সংস্থা অ্যামাজ়ন। ২০২০ সালের করোনা অতিমারি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বড় ধাক্কা দিয়েছিল। তার পর থেকেই কর্মী নিয়োগ নীতিতে বদল আনে সেখানকার অধিকাংশ টেক জায়ান্ট সংস্থা।
কর্মী সঙ্কোচনের দ্বিতীয় কারণ হিসাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজ়েন্স বা এআই) ব্যাপক ব্যবহারের কথা বলেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের কথায়, টেক সংস্থাগুলি বর্তমানে আরও উন্নত কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি তৈরির দিকে নজর দিয়েছে। এআইকে কাজে লাগিয়েই সেরে ফেলছে যাবতীয় কাজ। ফলে ছোট হচ্ছে চাকরির বাজার।
কর্মী সঙ্কোচনের দ্বিতীয় কারণ হিসাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজ়েন্স বা এআই) ব্যাপক ব্যবহারের কথা বলেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের কথায়, টেক সংস্থাগুলি বর্তমানে আরও উন্নত কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি তৈরির দিকে নজর দিয়েছে। এআইকে কাজে লাগিয়েই সেরে ফেলছে যাবতীয় কাজ। ফলে ছোট হচ্ছে চাকরির বাজার।
বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, বর্তমানে শুধুমাত্র ব্যবসায়িক জ্ঞান থাকা এমবিএ স্নাতকেরা আর কাজের বাজারে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন না। বরং প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকলে তবেই মিলছে চাকরি। এর অর্থ হল, নিয়োগকারী সংস্থার কাছে ঐতিহ্যবাহী এমবিএ শিক্ষার্থীর কোনও মূল্য নেই। কাজের বাজারে দর বাড়াতে এর পাঠ্যসূচিতে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন তাঁরা।
হার্ডার্ভ, স্ট্যানফোর্ড এবং ওয়ার্টনের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের এমবিএ শিক্ষার্থীদের বড় অংশই ঋণ নিয়ে পড়তে আসেন। আর তাই কেরিয়ারের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাঁদের। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক পরিকল্পনা করতে পারেন না তাঁরা। স্নাতক ডিগ্রি পাওয়ার পর বেকার থাকার নেপথ্যে একে অন্যতম বড় কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’।
হার্ভার্ডের ক্রিস্টেন বলেছেন, ‘‘এই পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাবে, এমনটা নয়। আমাদের বিকল্প রাস্তা খুঁজে বার করতে হবে।’’ বর্তমানে একটি এআই টুল নিয়ে কাজ করছে আমেরিকার এই জনপ্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর সাহায্যে কোন পড়ুয়ার কোন ধরনের চাকরির জন্য আবেদন করা উচিত, তার সুপারিশ পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন ক্রিস্টেন।
সংবাদ সংস্থা ফোর্বস আবার জানিয়েছে, কম বেতনে কাজ পেতে এমবিএ স্নাতকদের খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। যাঁরা উচ্চ বেতনের প্রত্যাশা করছেন, তাঁদেরই ডিগ্রি পাওয়ার পর বেকার থাকতে হচ্ছে। তবে কাজের বাজারে দক্ষতা যে ডিগ্রিকে ছাপিয়ে গিয়েছে তা নিয়ে সহমত পোষণ করেছে ফোর্বস।