গাজীপুরে মন্দির পাহারা দিচ্ছেন মুসলিমরা। ছবি: প্রথম আলো।
রাতভর জেগে হিন্দু মন্দির, উপাসনালয় পাহারা দিচ্ছে মুসলিম ছাত্র-জনতা। সংখ্যালঘু সুরক্ষায় লাঠি হাতে পাহারায় নেয়ামত, আকবর, আজিজুররা । সোমবার রাত থেকে এমনই দৃশ্য দেখা গেল বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’ জানাচ্ছে, গাজীপুরে মন্দির-সহ বিভিন্ন সরকারি দফতরের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন ‘ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর সদস্যেরা। মঙ্গলবার সকাল থেকে গাজীপুর চত্বরের বিভিন্ন মন্দিরের প্রধান ফটক পাহারা দিচ্ছেন তাঁরা। ‘ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর গাজীপুর শাখার সভাপতি এসএম ওয়াহিদুল ইসলাম বলেছেন, ‘‘দলের প্রধানের নির্দেশে সারা বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির পাহারা দেওয়া হচ্ছে। আমরা বাঙালি, সবাই ভাই ভাই।’’
ওয়াহিদুল ‘প্রথম আলো’কে বলেন, ‘‘সংখ্যালঘুদের বাড়ি কিংবা মন্দিরে হামলা রুখতে আমরা পাহারায় বসেছি। এ ছাড়া সরকারি বিভিন্ন দফতরের সামনে নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন আমাদের সদস্যেরা। কেন্দ্র থেকে পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা এই দায়িত্ব পালন করে যাব।’’
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর যাতে আক্রমণ না হয়, সে বিষয়ে সমস্ত রাজনৈতিক দল তথা দেশবাসীকে সতর্ক থাকার বার্তা দিয়েছেন গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা জোনায়েদ সাকী। মঙ্গলবার জোনায়েদ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে যে সব হামলার ঘটনা ঘটছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। বিশেষত সাম্প্রদায়িক আক্রমণের ঘটনা রুখে দিতে হবে কঠোর হাতে। বলেছেন, ‘‘ছাত্র-জনতার সম্মিলিত আন্দোলনের সাফল্য যাতে সুবিধাবাদী শক্তির হাতে না যায়, সে জন্য সবাইকে সংযমের পরিচয় দিতে হবে।’’ জোনায়েদ আরও জানাচ্ছেন, সোমবার বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতাদের যে বৈঠক হয়েছে, সেখানেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে একই রকম উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন তাঁরা।
প্রসঙ্গত, সোমবার রাতে একটি সাংবাদিক বৈঠকে একই সুরে বার্তা দেন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। নাহিদ বলেন, “দল, মত ও ধর্মনির্বিশেষে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ। কোনও ধরনের সাম্প্রদায়িক উস্কানি, নাশকতা বা বিভাজনের চেষ্টা হলে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে তা রুখে দিতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে এবং দেশের সম্পদ রক্ষা করতে হবে।”
জামাতের পক্ষ থেকে সংখ্যালঘুদের কোনও রকম আক্রমণ বা ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকার আবেদন জানিয়েছেন শফিকুর রহমানও। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ‘ঢাকা পোস্ট’-এর এক প্রতিবেদনে মঙ্গলবার শফিকুরের বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের উপাসনালয়, বাড়িঘর ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নিয়ে সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। কোনও দুষ্কৃতী যেন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অশান্তি সৃষ্টি করতে না পারে। সব দলের কর্মীদের তো বটেই, সাধারণ মানুষকেও সজাগ থাকতে হবে।’’ ঐক্যবদ্ধ ভাবে ‘সুন্দর দেশ’ গড়ার ডাক দিয়েছেন তিনি।
একই কথা শোনা গিয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ইসলামি ধর্মগুরুর মুখেও। সে দেশের জনপ্রিয় ইসলামি আলোচক শায়খ আহমদুল্লাহ আজহারী এক ভিডিয়োবার্তায় বলেছেন, ‘‘বিজয়োৎসবের মধ্যে কোনও সংখ্যালঘু যেন আহত না হন, সকলকে তা নিশ্চিত করতে হবে।’’ ‘প্রথম আলো’তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেছেন, ‘‘সংখ্যালঘুদের উপর যেন কোনও আক্রমণ না হয়। তাঁদের রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।’’
সোমবার দুপুরে প্রবল জনরোষের মুখে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এই খবর ছড়িয়ে দেশ জুড়ে শুরু হয় উদ্যাপন। বঙ্গভবন থেকে সংসদ ভবন— সব কিছুরই দখল নেয় উন্মত্ত জনতা। শুরু হয় লুটপাট, ভাঙচুর। ভাঙা হয় একের পর এক ভাস্কর্য। ছড়াতে থাকে নানা গুজব। যার অধিকাংশই সংখ্যালঘুদের নিয়ে। কয়েকটি এলাকায় সংখ্যালঘুদের উপর হামলার অভিযোগও উঠেছে। তারপরই সারা রাত জেগে বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্দির ও সরকারি দফতর পাহারা দিয়েছেন মুসলিম যুবকরা। কোথাও মাদ্রাসার ছাত্রেরা রাতভর আগলে রেখেছেন হিন্দু উপাসনালয়, কোথাও আবার রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান দরজা আটকে পাহারায় থেকেছেন। অগ্নিদগ্ধ বাংলাদেশে এই টুকরো ছবিগুলিই এখন আশার আলো।