এব্রাহিম ইসমাইল এব্রাহিম
বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর নিরলস লড়াই সে ভাবে হয়তো স্বীকৃত হয়নি দেশে-বিদেশে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যাঁরা সাক্ষী, তাঁদের সকলের কাছে অতি পরিচিত নাম এব্রাহিম ইসমাইল এব্রাহিম। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত, ভারতীয় বংশোদ্ভূত সেই সংগ্রামীর জীবনাবসান ঘটেছে। বয়স হয়েছিল ৮৪। সোমবার এক বিবৃতি জারি করে এই খবর জানিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার শাসকদল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)।
বন্ধুমহলে পরিচিত ছিলেন ‘এবি’ নামে। সহযোদ্ধারা আদরের ডাকনামের আগে জুড়ে দিয়েছিলেন ‘কমরেড’। জন্ম বর্ণবৈষম্যে দীর্ণ ডারবানে, ১৯৩৭ সালের ১ জুলাই। ছোটবেলা থেকেই দেখতেন, কী ভাবে ‘কালা আদমিদের’ উপরে নিপীড়ন চালায় শ্বেতাঙ্গেরা। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এব্রাহিম ও তাঁর আত্মীয়দেরও নানা হেনস্থার শিকার হতে হত। তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা ছিল না ভারতীয়দেরও। সেই আইন ভাঙার জন্য দু’বার জেলে যেতে হয়েছিল এব্রাহিমের বাবাকে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবি। বেছে নেন গাঁধীর দেখানো অহিংস রাজনীতির পথ।
তার কয়েক বছর পর থেকেই এব্রাহিম এএনসি-তে যোগ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু দু’টি কারণে তখন তাঁকে সদস্যপদ দেয়নি দল। প্রথমত, তাঁর বয়স। তাঁকে জানানো হয়, এত কম বয়সিদের সদস্য করে না দল। দ্বিতীয় কারণ— এবির ভারতীয় পরিচয়। তখনও অ-আফ্রিকানকে সদস্য করত না এএনসি। অগত্যা তিনি যোগ দেন নেটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেসে। সেটা ১৯৫৫-র কথা। সবে ১৮তে পা দিয়েছেন এবি।
এব্রাহিমের রাজনৈতিক আন্দোলনের দিশা আমূল পাল্টে যায় ১৯৬০-এ, শার্পভিল হত্যাকাণ্ডের পরে। সে বছর ২১ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকার ছোট্ট শহর শাপর্ভিলে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে এক শান্তিপূর্ণ জমায়েতে গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। নিহত হন ৬৯ জন, আহত প্রায় দু’শো। সে দিন বিক্ষোভ সমাবেশে ছিলেন এবি-ও। চোখের সামনে সেই হত্যাকাণ্ড দেখে তাঁর মনে হয়, শুধু অহিংস রাজনীতির পথ ধরে থাকলে কৃষ্ণাঙ্গেরা কখনওই তাঁদের অধিকার কায়েম করতে পারবেন না। সে বছরই এব্রাহিম যোগ দেন এএনসি-র সশস্ত্র বাহিনীতে। সে বার আর তাঁকে ফেরায়নি দল।
১৯৬৩-তে প্রথম জেল। কুখ্যাত রবেন আইল্যান্ডে পাঠানো হয় এব্রাহিমকে। সেই জেলে তাঁর সঙ্গী ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা এবং জেকব জ়ুমা। আত্মজীবনীতে এবি লিখেছিলেন, ‘‘জেলে আমাদের দিনের পর দিন খেতে দিত না। জামা-কাপড়ও দিত না যথেষ্ট। সারা দিন পাথর ভাঙা ও আরও নানা হাড়ভাঙা খাটুনি আর রাতে হাড়হিম ঠান্ডা। আমাদের ওরা মানুষ বলেই ভাবত না।’’ প্রথম দফায় ১৫ বছর জেলে ছিলেন এব্রাহিম। হাজার কষ্টের মধ্যেও জেল থেকেই পড়াশোনা করতেন। বন্দিদশাতেই বি এ এবং বি কম ডিগ্রি পান। ১৯৭৮-এ মুক্তির পরে ফের সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। আবার বন্দি হন ১৯৮৬-তে। এ বারের ঠিকানাও সেই রবেন আইল্যান্ড। মুক্তি পান ১৯৯১-এ।
১৯৯৪-এ পালাবদল হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়। ক্ষমতায় আসে এএনসি। মন্ত্রী হন এব্রাহিম-ও। কিছু দিন আগে পর্যন্ত তাঁকে নিয়মিত দলীয় সভা-সমাবেশে দেখা যেত। এ বছর জুন মাসে একটি ফরাসি সংবাদ সংস্থাকে সাক্ষাৎকারে এব্রাহিম বলেছিলেন, ‘‘দেশের এত মানুষ এখনও এত গরীব, এত কষ্টে রয়েছেন! তার মানে, গণতন্ত্রের সুফল আমরা সকলের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দিতে পারিনি। এটা আমাদের, আমাদের আন্দোলনের ব্যর্থতা।’’