গেটি ইমেজেস
নশ্বর জীবন, অমৃতলোক ইত্যাদি গতানুগতিক শব্দবন্ধে তিনি বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু ৮৫ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর পর একটা প্রশ্ন করাই যায়। পরজন্মে কতটা হাঁটতে হল স্যর বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ নয়পলকে?
হাঁটার কথাই বলেছিলেন ২০০১ সালে তাঁর নোবেল-বক্তৃতায়। ‘রোজ দিদিমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্কুল। দু’তিনটে বড় রাস্তা, চিনা পার্লার, সিনেমা হল, সস্তার সাবান তৈরি-করা পর্তুগিজ কারখানা— এ সব চিরন্তন জিনিসকে পাশে রেখে রোজ সরকারি স্কুলের দিকে হেঁটে যাওয়া।’ জন্মভূমি ত্রিনিদাদের ছোটবেলার পাড়া-স্কুল-নস্টালজিয়া কোনও কিছুকে পাত্তা না দিয়ে ‘চিরন্তন’ বলে ঠাট্টা করা, এটাই তো ভি এস নয়পলের বৈশিষ্ট্য।
নোবেল পুরস্কারের প্রতিক্রিয়াতেই বলেছিলেন, ‘‘আমার দেশ ইংল্যান্ড ও আমার পূর্বসূরিদের দেশ ভারতের উদ্দেশে এক মহান সম্মান।’’ জিজ্ঞাসা করা হল, জন্মভূমি ত্রিনিদাদের কথা বললেন না?’’ অকপট উত্তর, ‘‘দূর, অত বলতে গেলে শ্রদ্ধার্ঘ্যটাই গুলিয়ে যাবে।’’ ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদী বেলুনকে এ ভাবে ক’জন চুপসে দিতে পারেন?
নয়পল অবশ্য প্রচলিত অনেক মেনস্ট্রিম ধারণাই চুপসে দেন। কখনও বলেন, ‘মেয়েরা আবেগপ্রবণ। ফলে জেন অস্টেন থেকে কেউই সাহিত্যিক হিসাবে প্রথম শ্রেণির নয়।’ নারীবাদীরা সঙ্গে সঙ্গে ভার্জিনিয়া উলফ্, টোনি মরিসনের নাম টেনে রে রে করে উঠলেন। আর এক বার লিখলেন, ‘ইসলাম আসলে ঔপনিবেশিকতার চেয়েও খারাপ। ইসলাম মেনে নেওয়া মানে, সেই জাতিগোষ্ঠী নিজের ঐতিহ্য অস্বীকার করছে।’ সে বার এডওয়ার্ড সইদও প্রতিবাদ করলেন। আর ভারতীয়রা অনেকে তাঁকে সহ্য করতেই পারে না। অপরাধ, ‘অ্যান এরিয়া অব ডার্কনেস’-এ লিখলেন— ‘‘এখানে লোকে সর্বত্র মলত্যাগ করে। রেললাইনের ধারে, মাঠের ধারে, রাস্তার ধারে, নদীর ধারে, সমুদ্রতীরে কোত্থাও মলত্যাগ করতে বাকি রাখে না।’’ হালে স্বচ্ছ ভারতের শোরগোল বা ‘টয়লেট: এক প্রেমকথা’ বলে দেয়, লেখক কতটা ভুয়োদর্শী ছিলেন! সবই সাফ লিখে দিতেন। তথাকথিত ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’-এর তোয়াক্কা তাঁর জন্য নয়।
নোবেল পুরস্কারে দিদিমার কথা বলেছিলেন। ত্রিনিদাদে দিদিমা সুজি কপিলদেও তাঁর মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সবাইকে ঘরজামাই রেখেছিলেন। নয়পলের বাবা শ্রীপ্রসাদ নয়পলও ব্যতিক্রম ছিলেন না। নয়পল লিখেছেন, ‘‘ওই বাড়িতে বাচ্চাদের লাঠি দিয়ে ঠ্যাঙানো হত। ভাষাগুলি উঠে এসেছিল ক্রীতদাসদের ফেলে-আসা জগৎ থেকে, ‘মেরে পিঠের চামড়া গুটিয়ে দেব।’ ‘মারতে মারতে পেচ্ছাপ বের করিয়ে দেব।’ বিশাল পরিবার, প্রায়ই ঝগড়া বাধত। সেটাই আমার ভিত্তিভূমি। কী ভাবে অন্যের বিরুদ্ধে প্রচার করতে হয়, নিজের স্বার্থে গাঁটছড়া বাঁধতে হয়, প্রয়োজনে বিশ্বাসঘাতকতা করতে হয় শিখে গিয়েছিলাম। সুতরাং পরে দুনিয়ার কোনও অভিজ্ঞতা আমাকে বেকায়দায় ফেলতে পারেনি।’’ ভারত থেকে ত্রিনিদাদে কুলিগিরি করতে-যাওয়া পরিবার থেকেই তো উঠে এসেছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের এই লেখক।
আরও পড়ুন: দশ বছর বয়স থেকে লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন
বছর তিনেক আগের জয়পুর সাহিত্য উৎসবের কথা মনে পড়ছে। সে বার নয়পলের প্রথম বিখ্যাত উপন্যাস ‘আ হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’-এর পঞ্চাশ বছর। সেটাই তাঁর শেষ এ দেশে আসা। পার্কিনসন্স রোগে ভুগছেন, হুইলচেয়ারে করে তাঁকে নিয়ে আসছেন স্ত্রী নাদিরা। বসুন্ধরা রাজের শহরে এক পাঠক প্রশ্ন করলেন, ‘ওই লেখাটা লিখেছিলেন কেন? ভারত উজ্জ্বল দেশ, মোটেও অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়।’ হুইলচেয়ারে বসা শরীর উত্তর দিল, “ওটা একটা অন্ধকার জায়গার বর্ণনা। যে অন্ধকার আমি আজীবন বুকে নিয়ে বেড়িয়েছি।”
লেখককে বুঝতে হবে তাঁর চিরসঙ্গী এই গোপন অন্ধকার থেকে। ১৯৩২ সালের ১৭ অগস্ট জন্মেছিলেন ঘরজামাই শ্রীপ্রসাদ নয়পল আর দোপদী কপিলদেও-এর দ্বিতীয় সন্তান। ‘পথের পাঁচালী’র অপুর বাবা হরিহর যেমন ব্যর্থ লেখক, ভিদিয়ার বাবা শ্রীপ্রসাদ নয়পলও তেমন। স্কলারশিপ নিয়ে বিদ্যাধর অক্সফোর্ডে পড়তে গিয়েছেন, দিদি কমলা বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে। কমলাকে বাবার চিঠি, ‘ভিদিয়া এসেছিল। আমার ওপর সেই চোটপাট, চেঁচামেচি। ও আর বদলাল না।’ দিদি আবার ভারত থেকে লিখলেন, ‘বেশি মদ, সিগারেট খাস না।’ নয়পলের উত্তর, ‘‘তুই একটা ছাগল। গত তিন সপ্তাহ সিগারেট খাই। মিস নয়পল, চিঠি পড়ে বুঝলাম, বিপথগামী ভাইকে সিধে রাস্তায় আনার জন্য লেখাই তোমার পছন্দের।’’ ব্যর্থ বাবার দুই প্রবাসী সন্তানের পত্রালাপ। দুর্গা বেঁচে থাকলে কি ভাইবোনে এ রকম পত্রালাপ চলত না?
এই যে কড়া দিদিমার শাসন, দিদির সতর্কতা, এ সব থেকেই কি উঠে আসে ‘আ বেন্ড ইন দ্য রিভার’ উপন্যাসের শুরুর লাইন: The world is what it is; Men who are nothing, who allow themselves to become nothing have no place in it. বাবা শ্রীপ্রসাদকেও কি মনে পড়ায় না এই লাইন? তত দিনে বাবার আদলে মাস্টারপিস ‘আ হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’ লিখে ফেলেছেন নয়পল।
অন্ধকার ছিল না একটা জায়গায়। তুলসা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাঁর ডায়েরি, চিঠিপত্র, অনেক কিছু ৬ লক্ষ ডলারে বিক্রি করেছিলেন লেখক। শর্ত ছিল, মৃত্যুর আগে ওগুলি খোলা যাবে না।
সেই শর্ত নিজেই ভেঙে জীবনীকার প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চকে কাগজগুলি পড়তে দিয়েছিলেন লেখক। বলেছিলেন, ‘লেখকদের জীবন অবশ্যই খতিয়ে দেখা উচিত। হয়তো লেখার চেয়েও সেটা আরও ভাল ভাবে সংস্কৃতির ইতিহাস তুলে ধরতে পারে।’ সেই সব কাগজেই দেখা গেল, স্ত্রী থাকতেও কী ভাবে আর্জেন্টাইন বান্ধবীকে নিয়ে দেশে দেশে উড়ান দিয়েছেন লেখক, কাশ্মীরের হাউসবোটে স্ত্রীকে মেরেছেন, দুই নারীকেই যৌনতার পুঁটলি ছাড়া আর কিছু ভাবেননি।
নিজের অন্ধকার নিয়ে লুকোছাপা করেননি। বুকের মধ্যে অন্ধকার বয়ে ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যকে আলোর দিশা দেখিয়ে চির বিদায় নিলেন তিনি।
বিদায়, ভিদিয়া!