প্রেসিডেন্টের অভিষেকে বিদায়ী প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতির ঘটনা যদিও নতুন নয়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সিংহাসনে রাজা বসবেন আর কাঁসরঘণ্টা বাজবে না এমনটা অস্বাভাবিক। ক্যালেন্ডার বলছে এবারও আমেরিকার বিশে জানুয়ারি আগতপ্রায়। সময়ের মুশকিল হল সে কিছুতেই গোঁত্তা খেয়ে অপেক্ষায় থাকে না। না হলে চতুর্থ মাত্রাকে বোতলবন্দি করে বিশে জানুয়ারি আসতে দেরি আছে এই যুক্তিতে ট্রাম্প সাহেব গদি আঁকড়ে বসে থাকতে পারতেন। ঘড়ির কাঁটা তেমনটা আস্তে ঘুরছে না। বাইডেনের অভিষেক শুধু সময়ের অপেক্ষা। যদিও এই পরিবর্তনের সময়টা ‘প্রথম বিশ্বের দেশ’-এর পক্ষে ভাল যাচ্ছে না। মোটের উপর আমেরিকার গণতন্ত্র সুঠাম। এই ধরনের খুচরো সর্দিকাশিতে সে দেশ খুব বেশি ভোগে না।
যদিও ইতিহাস ঘাঁটলে উদাহরণ কিছু আছে। যেমন এর আগে শেষবার ৪ মার্চ, ১৮৬৯। ওয়াশিংটন ডিসি-র সকাল গড়াচ্ছে দুপুরে। সঙ্গে সুরও কেটেছে। বিদায়ী অ্যান্ড্রু জ্যাকসন। তিনি আগামী প্রেসিডেন্ট ইউলিসিস গ্র্যান্টের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রথা অনুসারে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর স্ত্রী উদ্বোধনের দিন সকালে হোয়াইট হাউসে নবাগত এবং তার স্ত্রীকে (আমেরিকা এখনও মহিলা প্রেসিডেন্টের মুখ দেখে নি, সে ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী-টা বদলাত) স্বাগত জানান। কিছু পরে এক যৌথ কংগ্রেসনাল কমিটির হর্তাকর্তারা হোয়াইট হাউসে আসেন। এরপর পুরোটাই সংহতির দেখনদারি। সস্ত্রীক বিদায়ী ও নতুন প্রেসিডেন্ট একই গাড়িতে চড়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্যে ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ের উদ্দেশে রওনা হন। নব্য প্রেসিডেন্টের শপথগ্রহণের দিন অবশ্য ৪ মার্চ থেকে ২০ জানুয়ারিতে বদলে যায় পরবর্তীকালে।
তাই গল্পটা সাধারণ ভাবে প্রতি চার বছর অন্তর ২০ জানুয়ারির হাড়কাঁপানো শীতের সকাল থেকে দুপুর গড়ানোর সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তরের। তবে অনেক বছর পর সম্ভবত এ বার মিশে থাকছে একরাশ তিক্ততা, পুরনো ইতিহাসকে ফিরে ছোঁয়া। আমেরিকার গণতন্ত্র পরিণত হওয়ার আগে এমন ঘটনা ঘটেছে আরও দুবার। ১৮০১ সালে এই ঘটনা ঘটান জন অ্যাডামস। এর পর আবার সেই পথেই হাঁটেন তাঁর ছেলে জন কুইন্সি অ্যাডামস, ১৮২৯ সালে। অর্থাৎ এ বারে ট্রাম্পকে ধরলে মোট চার। কিন্তু আবার মনে করানো দরকার যে আগের এই সমস্ত ঘটনা কিন্তু আমেরিকার গণতন্ত্রের একেবারে শুরুর একশো বছরের। আর আজকেরটা দেড়শো বছর পার করে ঐতিহ্যের অস্বীকার। তবে চারটি ঘটনাতেই তিক্ততার মূল কারণ হল নির্বাচনে হার মেনে নিতে পারেন নি সিংহাসনে বসে থাকা রাজামশাই।
অশীলিত মন্তব্যে আমেরিকার গরিমায় কালো দাগ রেখে গেলেন ট্রাম্প।
সোজা কথায় প্রতিটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরে ২০ জানুয়ারি দুপুর ১২টায় বিদায়ী দেশনেতাকে পাশে নিয়ে আমেরিকায় শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটে, অভিষিক্ত হন নতুন প্রেসিডেন্ট। এমনকি, যে প্রার্থী সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের কাছে ভোটে হেরেছেন, তিনিও পাশেই দাঁড়িয়েই এই দিনটিকে পালন করেন। এখানে মূল অনুসিদ্ধান্ত হল নব নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির সার্বভৌমত্বকে বৈধতা দেওয়া। যেমনটা বলছিলাম, ১৮৬৯-এর সেই তিক্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে দীর্ঘ ১৫১ বছর পর। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন, তিনি জো বাইডেনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন না। উত্তরে বাইডেন মজা করে বলেছেন, এটি অবশ্যই তাঁর পূর্বসূরির একমাত্র সিদ্ধান্ত, যার সঙ্গে তিনি খুশিমনে একমত। অর্থাৎ এক অর্থে বাইডেনের জয়কেই বৈধতা দিতে চাইছেন না ট্রাম্প।
আপাতদৃষ্টিতে গোটা ঘটনাটা বেখেয়ালি ছেলের মুঠো থেকে তার প্রিয় খেলনা কেড়ে নেওয়ার ফলশ্রুতি হিসেবে হাত-পা ছড়িয়ে তুলকালাম ভাঙচুর আর কান্নাকাটি। তবে অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের দিক থেকে বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রেসিডেন্টের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান আমেরিকানদের কাছে তো কেবল যে কোনও একটা ‘দিন’ নয়। নয় শুধু লোকদেখানো একটা অনুষ্ঠান। নয় প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করা বিজয়ী প্রার্থীর পিঠ চাপড়ানোর মঞ্চ। বরং এ হল ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়— সব দূরত্বকে সরিয়ে রেখে দেশ আর সমাজকে একসুতোয় বাঁধার কার্যক্রম। এই দিন মৌলিক অধিকার এবং নাগরিক শক্তির জয় উদযাপন করার মুহূর্ত। যদিও এ বার এই সব আবেগমথিত কথাবার্তা কিছুটা হলেও ফাঁপা ঠেকছে।
প্রায় সমস্ত আমেরিকান প্রেসিডেন্টই উদ্বোধনী ভাষণটি গোটা জাতির সামনে আগামীর ইস্তাহার হিসেবে পেশ করেন। শুধু বাতাসে ছুড়ে দেওয়া বিক্ষিপ্ত কিছু শব্দাংশ নয়, বরং পরবর্তী চার বছর অনুসরণ করার একটি সনদ এই বক্তৃতা। এ এমন একটি উপলক্ষ যা নীতিভিত্তিক সহযোগী এবং অসহযোগী নাগরিককে একই ছাতার তলায় আনার সুযোগ দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিক্ত নির্বাচনভিত্তিক আমপানের পর এ যেন দখিনা বাতাস। সেই কারণেই আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের উদ্বোধনী ভাষণগুলি দৃষ্টান্তমূলক। এমনিতেই সে দেশের রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক শুনলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে সেগুলো বর্তমান বাংলার সান্ধ্যকালীন তরজা-চচ্চড়ির থেকে একেবারে আলাদা। তাঁদের বক্তব্য থেকে অনেক সময়েই উঠে আসে কালজয়ী উদ্ধৃতি। যেমন গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত জাতির ক্ষতে মোলায়েম প্রলেপ দেওয়া আব্রাহাম লিঙ্কনের শান্তির বার্তা, ‘‘কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়, সকলের জন্য দানশীলতা’’ (‘বদলা নয় বদল চাই’ মনে পড়ছে কি?)। টেডি রুজভেল্টের মনে করানো যে মার্কিনি গণতন্ত্রের গুরুত্ব কেবল আমেরিকানদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির। ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের গ্রেট ডিপ্রেশনের সময়ের জাতিকে টেনে তোলার বার্তা, ‘‘আমাদের ভয় করা বাকি একমাত্র ভয়কেই।’’ আধুনিক সময়ে কেনেডি তাঁর সহ-নাগরিকদের আবেদন করেছিলেন যে দেশ তাকে কী দিতে পারে না ভেবে, ভাবা দরকার সে দেশকে কী ফিরিয়ে দিতে পারবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নতুন প্রেসিডেন্ট তাঁর সহ-নাগরিকদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন ভবিষ্যৎ নির্ধারণের দায় নিয়ে। অর্থাৎ বারবার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে বিশে জানুয়ারির সম্বোধন একটি নিছক রাজনৈতিক বক্তৃতা নয়।
ক্যাপিটলে হামলার আগুন কি আসলে আমেরিকার অভ্যন্তরের ছবি?
যে হেতু এই দিনটি আমেরিকার প্রতিটি নাগরিক এবং সমস্ত গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আসন্ন বুধবারের উদ্বোধনটি কেন এ বার একটু অন্যরকম এবং সাম্প্রতিককালের ঘটনাবলীর আবহে কেন আরও তাৎপর্যপূর্ণ সেটা ভাবা দরকার। গত নভেম্বরে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয়েছে ট্রাম্পবাদী মিথ্যাচার ও হুমকি। তার উপসংহারে দেশের প্রেসিডেন্ট উস্কানি দিলেন তাঁর সমর্থকদের, আর সেই দাঙ্গাবাজেরা আক্রমণ করে বসল আমেরিকার গণতন্ত্রের মন্দির ক্যাপিটল বিল্ডিং। এই অবস্থায় দলমত নির্বিশেষে সে দেশের রাজনৈতিক নেতা এবং আপামর জনসাধারণ ঠাওর করলেন, সময় এসেছে নিজেদের মুখের সামনে আয়না ধরার। হয়ত সেই প্রেক্ষিতেই ভীষণ জরুরি ছিল গণতন্ত্রের উৎসবে বিদায়ী প্রেসিডেন্টের উপস্থিতি। বিশেষত, গত দু সপ্তাহের ঘটনাবলীর পর সত্যিই দেখানোর দরকার ছিল যে সমস্ত তিক্ততার পরও দেশ ও জাতির স্বার্থে বিদায়ী এবং নব্য প্রেসিডেন্ট এক মঞ্চে দাঁড়াতে পারেন।
ভবিষ্যতের জন্য বেশ ভয়াবহ একটা উদাহরণ রেখে যাচ্ছেন ট্রাম্প মহাশয়। বাইডেনও এখন অত্যন্ত সাবধানী, হয়ত বা বিরক্তও বটে। ফলে হাত ধরে ট্রাম্পকে মঞ্চে ডেকে আনার মহানুভবতা দেখানোর সাহস কিংবা উৎসাহ, কোনটাই তিনি বোধহয় পাচ্ছেন না। মাথায় রাখতে হবে, এই উদাহরণ মাথায় রেখে ভবিষ্যতে আরও প্রভাবশালী এবং বিভেদকামী কোন ট্রাম্প আবির্ভূত হতেই পারেন। আপাতত গোটা আমেরিকার সমাজ খুব সাবধানে পা ফেলছে। দীর্ঘকালের বেশ কয়েকটি প্রথা এবার আর পালিত হচ্ছে না। হচ্ছে না ক্যাপিটল মলে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে আনন্দঘন অনুষ্ঠান উদযাপন। সম্ভবত ট্রাম্প সমর্থকদের সাথে তিক্ত দ্বন্দ্ব এড়াতে এবারের মতো বন্ধ রাখা হয়েছে সনাতনী কার্যক্রম। এয়ারবিএনবি-র মত সংস্থা ওয়াশিংটন ডিসির আশেপাশের ঘরবাড়ি কয়েকদিনের জন্যে ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কয়েকটি বিমান পরিচালক সংস্থা বুধবার পর্যন্ত চেক-ইন লাগেজে সমস্ত হ্যান্ডগান নিষিদ্ধ করেছে। এখনও শোনা যাচ্ছে ২০ জানুয়ারি বিভিন্ন রাজ্যে সংসদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে পারেন সশস্ত্র ট্রাম্পপন্থীরা।
ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে হোয়াইট সুপ্রিমেসির উদ্গাতা হিসেবে।
আসলে আমেরিকার প্রেক্ষিতে এখন অন্য দেশের চেয়ে নিজেদের বেশি করে দেখানোর সময় এসেছে যে কোন ক্ষমতাশালী ব্যক্তির আত্মপ্রিয়তা এবং বিভেদকামী চিন্তাধারা থেকে মুক্তি পেতে তাদের খুব বেশি সময় লাগে না। তারা প্রমাণ করতে চাইছে জনগণ দ্বারা নির্ধারিত এবং সময় পরীক্ষিত প্রণালী ও প্রতিষ্ঠান অতীতেও শক্তিশালী ছিল, আজও আছে, এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। আমেরিকাকে তাই চটজলদি দেখাতে হবে যে ঘৃণা এবং গোঁড়ামি সর্বদা হেরে যায়। এটাও সত্যি যে সে দেশের সমাজের একটা বড় অংশ মনে করছে যে ভুল তো হয়েই ছিল, এবং তা প্রকাশ্যে মেনে নিতে কোনও লজ্জাবোধের কারণ নেই।
তাঁরা মানছেন যে মার্কিন সমাজের অভ্যন্তরে বেশ কিছু স্তরে গোঁড়ামি, অশিক্ষা, নিরাপত্তাহীনতা এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ লুকিয়ে আছে। তা অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। কখনওই পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হবে না। এর মূল কারণ হল, যে কোন নেতাই সমাজের প্রতিফলন। ট্রাম্প নিজে থেকে রাজনীতির আঙিনায় আবির্ভূত হয়ে মার্কিন জনগণকে হঠাৎ ক্ষেপিয়ে তুলেছেন এমনটা নয়। বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণে উগ্র জাতীয়তাবাদ জেগে উঠেছিল আমেরিকায়। এ বারেও ট্রাম্পের প্রাপ্ত ভোট বাইডেনকে বাদ দিলে মার্কিন ইতিহাসে সবথেকে বেশি। এমনটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে। ট্রাম্পও সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন এবং তারপর কোথায় গিয়ে থামতে হবে বুঝে উঠতে পারেননি। ট্রাম্প-রাজত্বে উগ্র দক্ষিণপন্থী ভাবনার যে তীব্র আত্মপ্রকাশ, তার পুনরাবৃত্তি চাইছেন না সে দেশের অধিকাংশ মানুষ।
আমেরিকায় একটি প্রচলিত কথা আছে, যা আপনাকে চেষ্টা করেও ধ্বংস করতে পারে না, তা আপনাকে আখেরে শক্তিশালীই করে তোলে। তাই ট্রাম্প রাজত্ব এবং মূলত তার শেষ দিকটাকে তাকের কোণে অগ্রাহ্য করা লুকোনো ধুলো বলেই মনে করছেন গণতন্ত্রপ্রিয় মার্কিন নাগরিককুল। আশা করছেন ঝেড়ে ফেলা গেল উটকো ঝামেলা। ঘটনা সত্যিই তাই, নাকি চিরন্তন বিভাজন সিঁধ কেটে ঢুকে পড়ল তা বুঝতে অপেক্ষা করতে হবে অনেকটা সময়। এ টুকু শুধু মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, স্বদেশে গণতন্ত্র অটুট রাখতে চাইলেও বহির্বিশ্বে সার্বভৌমত্ব ধ্বংসে আমেরিকানদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন থেকেছে গত বহু বছর ধরে। সেই কারণেই ব্যঙ্গোক্তি উড়ে আসছে সারা দুনিয়া থেকে। যদিও সে আলোচনা এই লেখার বিষয় নয়।
বাইডেন-হ্যারিস যৌথ নেতৃত্বের উপর ভরসা রাখছে বিশ্বও।
তবে মার্কিন দেশের অন্দরেই যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে সেটা হয়ত ট্রাম্পের পূর্বসূরি কিছুটা হলেও আঁচ করেছিলেন। বারাক ওবামা হোয়াট হাউস ছাড়ার দিন ওভাল অফিসের রেসোলিউট ডেস্কে ট্রাম্পের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি রেখে গিয়েছিলেন। তার মর্মার্থের কিছু অংশ আজকের আলোচনার প্রেক্ষিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তাতে লেখা ছিল, ‘‘এটি একটি অনন্য দায়িত্ব। আমাদের ওপরই নির্ভর করে কঠোর পরিশ্রম করতে ইচ্ছুক প্রতিটি শিশু এবং পরিবারের জন্যে সাফল্যের সিঁড়ি প্রস্তুত করা। যে কোন রাষ্ট্রপতি এই প্রতিষ্ঠানের অস্থায়ী কর্মচারী মাত্র। আমাদের সেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং ঐতিহ্যের সাময়িক অভিভাবকত্বটুকু দেওয়া হয়, যেখানে প্রয়োজন আইনের শাসন, ক্ষমতা পৃথকীকরণ, নাগরিক স্বাধীনতা, সমমান, সুরক্ষা ও মর্যাদা বজায় রাখা— যা আমাদের পূর্বসূরিরা বহু পরিশ্রমে অর্জন করেছিলেন। মনে রাখতে হবে, সাধারণ রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের দায়িত্ব এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে আমরা যতটা শক্তিশালী হিসাবে পেয়েছি, ন্যূনতম সেটুকু যেন রেখে যেতে পারি।’’ ওবামার লেখা চিঠির খামে ট্রাম্পকে গোটাগোটা অক্ষরে সম্বোধন করা হয়েছিল ‘প্রেসিডেন্ট’ বলে। জানা নেই ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই চিঠি আদৌ পড়েছিলেন কি না। পড়লেও তিনি কালো সাহেবের কথা একেবারেই কানে তোলেন নি। তাঁর রাজত্বের চার বছর সে কথা নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ করে। যে আত্মপ্রিয় মানুষটি অন্যায় ভাবে ন্যায্য এবং নির্দিষ্ট গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত রাষ্ট্রনায়ককে চুরি করে নির্বাচন জেতার অপবাদ দেন, গণতন্ত্রের মন্দিরকে আক্রমণ করার প্ররোচনা দেন, তার পক্ষ থেকে কোনও খামে লেখা চিঠিতে উপদেশ বা সাহায্যের হাত বাড়ানো থাকবে না সেটা বোঝার জন্যে মহাকাশবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই।
আগতপ্রায় ২০ জানুয়ারি তাই কিছুটা অন্যরকম। উদযাপনের আগে অবশ্যই যথেষ্ট কুণ্ঠিত। দেখা যাক বাইডেন-বক্তৃতা অন্য উচ্চতায় পৌঁছে মার্কিন আমজনতাকে শুরুর স্বস্তিটুকু দিতে পারে কি না। স্বাভাবিক কারণেই তাই বিশ্বজুড়ে উদারবাদী মানুষ অপেক্ষা করে থাকবে বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্রের পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা তাঁর জাতি ও বিশ্বের উদ্দেশে কি ইতিবাচক বার্তা রাখেন তা শোনার জন্যে। সেই কারণেই আসছে বুধবারটা একটু আলাদা। ওবামার মনে করিয়ে দেওয়া অনন্য দায়িত্ব শুধু বাইডেনের নয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ক্যাপিটলের আশপাশে হাঁটতে না পারলেও, টেলিভিশনের সামনে উন্মুখ হয়ে বসে থাকবেন অনন্য দায়িত্ব ধরে রাখা আমজনতা। সুযোগ পেলেই যখন গণতন্ত্রের গলায় ফাঁস শক্ত করছেন রাজনীতির অধিকাংশ কারবারি, সেই সময় ট্রাম্পের উৎপাত নতুন করে গণতন্ত্র উদযাপনের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। যে সব দেশে এখনও ভোট দেওয়া যায়, সেখানকার মানুষজন বিষয়টা নজরে রাখছেন কি?
(উদয়ন ভট্টাচার্য ইনটেল কর্পোরেশন, সান্টা ক্লারা, ক্যালিফোর্নিয়াতে কর্মরত প্রযুক্তিবিদ এবং শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট, কলকাতার অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত।)