নাম মোল্লা আবদুল গনি বেরাদর। তবে তালিবানের কাছে তিনি জনপ্রিয় 'মোল্লা ব্রাদার আখুন্দ' নামে।
পার্সি শব্দ 'বেরাদর' ইংরেজিতে হয়েছে 'ব্রাদার' যার অর্থ 'ভ্রাতা'। 'আখুন্দ' শব্দটিও পার্সি। ‘আখুন্দ’ উপাধি দিয়ে সাধারণত পণ্ডিতদেরই কথাই বোঝানো হয়।
বেরাদরের পাণ্ডিত্য বা শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনও সরকারি শংসাপত্র পাওয়া যায় না। তবে তাঁর কৌশলের দক্ষতা ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় স্বীকৃত। আমেরিকাকেও বোকা বানিয়ে দিয়েছেন এই বেরাদর।
বেরাদরের পরিচয়, তিনি তালিবানের রাজনৈতিক প্রধান। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অনুমান সত্যি হলে বেরাদরই হবেন পরবর্তী আফগান প্রেসিডেন্ট। আর যদি তা হয়, তবে এই প্রথম কোনও শীর্ষ পদে বসবেন এই তালিবান কম্যান্ডার।
বেরাদর তালিবানের সর্বময় কর্তা বা প্রধান নেতা নন। কোনও দিনই ছিলেন না। সেই পদে আপাতত রয়েছেন হাইবাতুল্লা আখুন্দজাদা। বরাবর দ্বিতীয় স্থানে কাজ করা বেরাদরের ভূমিকা ছিল তালিবান কৌশলীর। আড়ালে থেকে প্রধানের মস্তিষ্ক হয়েই কাজ করেছেন। বহু বছর সে ভাবে সামনে আসেননি।
তবে প্রধান না হয়েও তালিবানের রাজনৈতিক অবস্থানের অভিমুখ তিনিই ঠিক করে দিয়েছেন। দেশে তো বটেই, এমনকি আন্তর্জাতিক মঞ্চেও তাঁর অবস্থানই ছিল তালিবানের শেষ কথা।
২০১৮ সালে আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন বেরাদরের সঙ্গে কথা বলেই তালিবানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করেছিল। তালিবান কম্যান্ডারের আশ্বাসেই আফগানিস্তান থেকে সেনাও সরিয়ে নেয় আমেরিকা। এমনকি পাকিস্তানের জেলে বন্দি বেরাদরকে মুক্ত করার নির্দেশও দিয়েছিলেন প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
আমেরিকাকে বেরাদর বুঝিয়েছিলেন, তালিবানও আফগানিস্তানে হিংসার বিরোধী। তারাও আসলে শান্তিই চায়।
রবিবার রাতে তালিবান সেনা আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভবনের দখল নেওয়ার পর সেই বেরাদরই বলেছেন, ‘‘এ তো সবে শুরু। তালিবানকে আসল পরীক্ষা এ বার দিতে হবে। দেশের মানুষকে প্রয়োজনীয় পরিষেবা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে হবে তালিবানকে।’’
বেরাদরের জন্ম ১৯৬৮ সালে কন্দহরে। জন্মসূত্রে এই তালিবান নেতা একজন দুররানি পাশতুন। দুররানিরা আফগানিস্তানের আদি গোষ্ঠী। এঁদেরই পূর্বপুরুষ আহমেদ শাহ দুররানি আধুনিক আফগানিস্তানের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
নামের সঙ্গে 'পণ্ডিত' জুড়লেও বেরাদরের শিক্ষা সংক্রান্ত কোনও তথ্য কোথাও নেই। তবে দেশের হয়ে যুদ্ধ করছেন কিশোর বয়স থেকেই। আটের দশকে সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণে চলা আফগান শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তখনই আফগান মুজাহিদিনের সদস্যও হয়েছিলেন। বেরাদরের সহযোদ্ধা ছিলেন তালিবানদের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ ওমর। ১৯৯২ সালে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয় আফগানিস্তান।
প্রেসিডেন্ট হয়ে বেরাদর যে দেশের নেতৃত্ব দেবেন, তার নাম হবে 'ইসলামিক এমিরেটস অব আফগানিস্তান'। বেরাদর এই দেশের স্বপ্ন দেখছেন সেই ১৯৯২ সাল থেকেই। আফগানিস্তানকে আমিরশাহি বানানোর লক্ষ্যে সেই সময়েই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি মাদ্রাসার। যার উদ্দেশ্য ছিল, আফগানিস্তানের ধর্মীয় শুদ্ধিকরণ করে তাকে প্রকৃত আমিরশাহী দেশ হিসেবে গড়ে তোলা।
মহম্মদ ওমর তখন ধর্মীয় নেতা। শোনা যায়, বেরাদরের ভায়রাভাই তিনি। ওমর এবং বেরাদরের উদ্যোগেই তৈরি হয় মাদ্রাসাটি। নাম দেওয়া হয় 'তালিবান'।
তালিবানের যাত্রা তখন থেকেই শুরু। আর ঠিক পাঁচ বছরের মাথাতেই সাফল্য আসে। ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের দখল নেয় তালিবান। রবিবার রাতে যে ভাবে কাবুল দখল করেছে তারা, ঠিক সে ভাবেই আফগানিস্তানে শুরু হয় তালিবানি শাসন। সেই রাষ্ট্রেও প্রধান ছিলেন ওমরই। বেরাদর দায়িত্ব নেন আফগান সেনাদের। সেই পদ বহু বার বদলেছে। ২০০১ সালে মার্কিন সেনারা যখন আফগানিস্তান থেকে তালিবানকে উৎখাত করে, তখন বেরাদর ছিলেন আফগানিস্তানের উপপ্রতিরক্ষা মন্ত্রী।
আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলেন বেরাদর। সেখানেই তালিবানদের প্রশাসনিক সংগঠন কোয়েত্তা সুরা গঠন করেন। তার পর বহু বার তালিবানের তরফে বোঝাপড়ার বার্তা নিয়ে আফগান প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছেন বেরাদর। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে সেই কথা অনেক দূর এগিয়েওছিল। একটা সময়ে বেরাদরকে তালিবানের 'শান্তির মুখ' হিসবে দেখতে শুরু করেছিল আন্তর্জাতিক দুনিয়াও। কিন্তু ২০১০ সালে আচমকাই বেরাদরকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান।
আন্তর্জাতিক মহলের একাংশ তখন বলেছিল এই গ্রেফতারির নেপথ্যে আমেরিকারই নির্দেশ রয়েছে। যদিও পরে আমেরিকাই বেরাদরকে মুক্তিও দিতে বলে। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান সংক্রান্ত উপদেষ্টা জালমায় খালিজাদ বেরাদরের সঙ্গে দেখা করেন। মুক্তি পেয়ে তখন কাতারের দোহায় রয়েছেন বেরাদর। সেখানেই আমেরিকার সঙ্গে তাঁর শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
এই চুক্তিতে তালিবানদের ক্ষমতা সংক্রান্ত সমঝোতায় আসার সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আমেরিকা। সঙ্গে আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয় আমেরিকার তরফে।
সে সময় অনেকেই এই চুক্তি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ এই পদক্ষেপের প্রশংসাও করেন। তাঁরা অবশ্য রবিবারের পর বলছেন, বেরাদর আসলে ওই চুক্তি সই করেছিলেন সময় পাওয়ার জন্য। যত দিনে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়েছে, ভিতরে ভিতরে প্রস্তুতি নিয়েছে তালিবান। সেনা সরলেই আক্রমণ করবে বলে।
আসলে কৌশলী বেরাদর বরাবরই ধৈর্যশীল। কারণ, তিনি জানেন সবুরেই মেওয়া ফলে।