গমগমে গলা হলেও উঁচু স্বরে কথা বলত না ছেলেটা। মুখচোরা, একা একা থাকতেই বেশি ভালবাসত। ফুটবল অন্ত প্রাণ। তবে খেলার মাঠে তাকে ধাক্কা মারলেও প্রতিবাদ করত না। যদিও গোল মিস করলে মেজাজ হারাত। ইরাকের ছাপোষা ঘরের সেই লাজুক ছেলেটিই কী ভাবে ধীরে ধীরে বিশ্বের ত্রাস আইএস জঙ্গি আবু বকর আল-বাগদাদিতে পরিণত হল?
ইরাকের প্রাচীন শহর সামারা। ১৯৭১-এ সেখানেই জন্মেছিলেন আইএস প্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি। ধর্মভীরু পরিবারের সেই ছেলেটির নাম রাখা হয়েছিল ইব্রাহিম আওয়াদ ইব্রাহিম আল-বদরি। পড়শিরা জানিয়েছেন, ছোটবেলায় বেশ লাজুক ছিল ইব্রাহিম। তবে তার দৃষ্টিতে একটা তেজ ছিল, যা কারও নজর এড়াত না।
ছোট থেকেই ইব্রাহিমের একটা ডাকনাম ছিল। ‘দ্য বিলিভার’। স্কুলে না থাকলে পাড়ার মসজিদেই সময় কাটত তার। নানা ধর্মগ্রন্থতে ডুবে থাকত সে। তার এক ভাই শামসি জানিয়েছেন, বাড়ি ফিরেও ধর্মের বাণী তার পিছু ছাড়ত না। ইসলাম বিরোধী কোনও কাজ করলে তাঁকে ডেকে সতর্ক করতেও ছাড়ত না ছোট্ট ইব্রাহিম।
বাগদাদিদের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে হিংসার জায়গা ছিল না। বরং পূর্বপুরুষদের বিশ্বাস ছিল, তাঁরা হজরত মহম্মদের বংশধর। বাগদাদির বাবা আওয়াদ স্থানীয় এলাকায় ধর্ম বিষয়ক অনুষ্ঠানে বেশ সক্রিয় ছিলেন। পাড়ার মসজিদে ছোটদের কোরান পাঠের শিক্ষা দিতেন আওয়াদ। মূলত বাবার কাছেই কোরানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় বাগদাদির।
বাগদাদির পরিবারে রাজনীতির প্রভাব কম ছিল না। তাঁর কয়েকজন আত্মীয় বাথ পার্টি নামে একটি সমাজবাদী সংগঠনের সদস্য ছিলেন। যে পার্টির সদস্যরা সরকারের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। তবে বাগদাদির দুই কাকা এক সময় সাদ্দাম হুসেনের সুরক্ষা বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর এক ভাই ইরাকি সেনানি হিসাবে ইরানের যুদ্ধে নিহত হন।
বাগদাদির ইচ্ছে ছিল বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করবেন। তবে হাইস্কুলে পরীক্ষায় কম নম্বর থাকায় সে ইচ্ছেপূরণ হয়নি। এক বার তো ইংরেজিতে প্রায় ফেল করে বসেছিলেন। শেষমেশ কোরান পাঠের জন্য ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন বাগদাদি।
১৯৯৬-এ বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক। এর পর সাদ্দাম হুসেন ইউনিভার্সিটি ফর ইসলামিক স্টাডিজ-এ ভর্তি হন বাগদাদি। সেখানেই স্নাতকোত্তর। এ বার তাঁর প্রিয় বিষয়, কোরানিক রিসাইটেশন। ’৯৯-এ মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ। এর পর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের জন্য সাদ্দাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ। সেখান থেকেই কোরানিক স্টাডিজ-এ ডক্টরেট।
স্নাতক স্তরে থাকাকালীন বাগদাদির এক কাকা তাঁকে মুসলিম ব্রাদারহুড-এর মতো দলে যোগদানে উৎসাহিত করেন। সেই সংগঠনের আন্তঃদেশীয় আন্দোলনেও শামিল হয়ে পড়েন।
স্নাতক স্তরে পড়াশোনার সময়ই বিদ্রোহের পরিবর্তে শান্তিপূণ উপায়ে সরকার পাল্টানোর মতো মতাদর্শেও আগ্রহ বাড়ে বাগদাদির। জিহাদিস্ট সালাফিস নামে পরিচিত সেই মানুষজনের মধ্যে বাগদাদির পরামর্শদাতা মহম্মদ হারদানও ছিলেন। মুসলিম ব্রাদারহুড সদস্য হারদান আটের দশকে আফগানিস্তানের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছিলেন।
এই সময় থেকেই জিহাদিদের বিভিন্ন লেখালেখি পড়তে শুরু করেন বাগদাদি। অন্য দিকে, মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিও তাঁর টান কমতে থাকে। তাঁর মনে হয়, শুধুমাত্র কথাই সার। কাজের কাজ কিছু করছে না ওই সংগঠন। সালটা ২০০০।
শুধুমাত্র মতাদর্শগত নয়, ২০০০ সাল থেকে বাগদাদির ব্যক্তিগত জীবনেও পরিবর্তন আসে। মায়ের তরফের এক কাকার মেয়ে আসমার সঙ্গে বিয়ে হয়। এর পর সম্ভবত, ২০০৩-এ ইসরার সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে। যদিও অনেকের মতে, বাগদাদির আরও একটি স্ত্রী ছিলেন। সন্তান সংখ্যা নিয়েও মতভেদ রয়েছে। কারও মতে তা তিনটি, কারও মতে ছ’টি।
কট্টর রক্ষণশীল মানুষের মতোই নিজের স্ত্রীদের লোকচক্ষুর আড়ালে রাখাটাই পছন্দ ছিল বাগদাদির। সকলের সঙ্গে মিশতেন না। বরং বাগদাদের হাজি জেদান মসজিদের কাছে পরিবারের সঙ্গে নিজের ফ্ল্যাটে সময় কাটাতেই বেশি ভালবাসতেন। এলাকার বাচ্চাদের কোরান পাঠ শেখানো বা মসজিদে আজান দেওয়াতেই আগ্রহ ছিল তাঁর।
হাজি জেদান মসজিদের একটি ফুটবল ক্লাবে ছিল। তাতে চুটিয়ে ফুটবলও খেলতেন বাগদাদি। তবে বাগদাদির ঘটনাবিহীন জীবনে বদল ঘটতে থাকে ২০০৩-এর শেষ দিকে।
২০০৩-এর শেষের দিক। মার্কিন সেনার হাতে পরাজিত সাদ্দাম হুসেন। সে সময়ই উত্তর ও মধ্য ইরাকে মার্কিন সেনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্থানীয় এক গোষ্ঠীকে সাহায্য করেন বাগদাদি। এর পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে গ্রেফতার হন তিনি। সেই বন্ধু মার্কিন প্রশাসনের ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় ছিলেন।
গ্রেফতারির পর বাগদাদিকে পাঠানো হয় ইরানের দক্ষিণাঞ্চলে বুক্কার ডিটেনশন শিবিরে। মার্কিন সেনা নিয়ন্ত্রিত সেই জেলে পৌঁছনোর আগেই যে জিহাদি মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েছেন বাগদাদি, তা জানতেও পারেননি তাঁর কর্তৃপক্ষ। ১০ মাস পর সেখান থেকে ছাড়া পান তিনি।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার দু’মাস আগে ইরাকে একটি শাখা খোলে আল কায়দা। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আল কায়দার ওই শাখার সদস্য, নিজের এক আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলেন বাগদাদি। তিনিই ওই শাখার মুখপাত্রের সঙ্গে বাগদাদির আলাপ করিয়ে দেন। ওই মুখপাত্রের উৎসাহে দামাস্কাসে আল কায়দার হয়ে কাজ করতে যান বাগদাদি।
এক সময় ওই শাখার শীর্ষ নেতার মৃত্যু হয়। এর পর আল কায়দার প্রধান ওসামা বিন লাদেন ইরাকের কয়েকটি প্রদেশের দায়িত্ব দেন বাগদাদিকে। সে সময় ২০০৭-এ ডক্টরেট ডিগ্রি পান বাগদাদি। ধীরে ধীরে আল কায়দায় গুরুত্ব বাড়তে থাকে তাঁর। পরে ওই সংগঠন ভেঙে ইসলামিক স্টেট-এর জন্ম হয়েছিল।
২০১০ সালে বিমানহানায় তৎকালীন ইসলামিক স্টেট অব ইরাক (আইএসআই)-এর বহু নেতা নিহত হলে বাগদাদিকে এই সংগঠনের সর্বেসর্বা করা হয়। এর পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি বাগদাদিকে।