9/11 Attack

‘একা একা মরতে চাই না, ফোন ছাড়বেন না প্লিজ়’

ঘটনাচক্রে, এর পাঁচ বছর পরে অফিসের কাজে নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলাম। আকাশচুম্বী টুইন টাওয়ার যেখানে ছিল, এখন সেখানে স্মৃতিসৌধ, যার পোশাকি নাম গ্রাউন্ড জ়িরো।

Advertisement

কৌশিক ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:৫৭
Share:

—ফাইল চিত্র।

‘‘প্লিজ়, ফোনটা ছেড়ে দেবেন না! কারও সঙ্গে কথা না বলে, এই ভাবে একা এখানে মরতে চাই না...! মানুষের কান্না, চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। চারদিক অন্ধকার।’’

Advertisement

১১ সেপ্টেম্বরের সকাল। ২০০১।

কাজ করি কলকাতার একটি কল সেন্টারে। নিত্যদিনের মতো অফিসে এসে ফোন ঘুরিয়েছিলাম নিউ ইয়র্কে। দু’বার রিং হতেই ধরেছিলেন ফিলাডেলফিয়ার রবার্ট জনসন। তাঁর ক্রেডিট কার্ড বিল বাকি। বকেয়া টাকা চাইতেই এই ফোন।

Advertisement

তখনও জানি না কী ঘটছে।

ক্রেডিট কার্ডের কথা তুলতেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে উত্তেজিত ভাবে জনসন বললেন, ‘‘হয়তো ওই কার্ড আর কখনও ব্যবহার করব না। আপনি কাউকে বলুন যে আমরা আটকে আছি। চারদিক অন্ধকার। এখনই যেন কেউ এখানে আসে।’’

‘‘কোথায় আছেন আপনি?’’

‘‘টুইন টাওয়ারের বেসমেন্টে।’’

বলছে কী লোকটা!

‘‘অনেক ক্ষণ ধরে মেয়ে আর স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। কেউ ফোন তুলছে না। মৃত্যুর আগে ওদের সঙ্গে কথা বলতে চাই,’’ কাতর গলায় বলছেন মাঝবয়সি রবার্ট।

থতমত খেয়ে ম্যানেজারকে ডাকি। ম্যানেজার এসেই বললেন, ‘‘এখনই ফোন রাখো। নিউ ইয়র্কে টুইন টাওয়ার ভেঙে পড়েছে।’’

ম্যানেজারের কথা মেনে ফোনটা রেখেই দিতে যাচ্ছিলাম। চিৎকার করে ওঠেন জনসন— ‘‘আমি কথা বলতে চাই। ফোন বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অন্তত আমার সঙ্গে কথা বলুন। হয়তো এটাই আমার শেষ কথোপকথন।’’

ধসে পড়া টুইন টাওয়ারের বিপুল ধ্বংসাবশেষের নীচে আটকে লোকটা। সেখানে আরও অনেক লোক আছে। চিৎকার, কান্না শোনা যাচ্ছে।

রবার্ট বলছেন, ‘‘চারদিকে কী চলছে, জানি না। ঠিক কী হয়েছে যে দু’টো বাড়িই ধসে পড়ল! এ জন্য হাজার হাজার লোক এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকে আছে। বাইরে কী হচ্ছে জানি না।’’

কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম। শুধু চুপ করে শুনে যাচ্ছি। হঠাৎ সম্বিত ফেরে জনসনের কথায়— ‘‘আপনি কী লাইনে আছেন? আপনার অবস্থা আমি বুঝতে পারছি।’’

অফিসের সিনিয়ররা সব আমার চেয়ারের পিছন ঘিরে দাঁড়িয়ে। চাপা গলায় কেউ কেউ বলছেন, ‘‘ফোন ছেড়ে দাও। এই ভাবে কথা বলে যেতে পারবে? পারবে না।’’

কিন্তু কথা তো বলে যেতেই হবে! যতক্ষণ না ওঁর ফোন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে...।

অম্তত ৩৫ মিনিট কথা বলেন জনসন। আমি সাড়া দিয়ে যেতে থাকি। এর পর কথা অস্পষ্ট হয়ে যেতে থাকে।

এক সময়ে সব চুপ। ফোনের অন্য প্রান্তে শুধু নীরবতা। জনসন... মিস্টার জনসন... রবার্ট...। বার বার নাম ধরে ডেকেও কোনও সাড়া পাই না আর।

ঘটনাচক্রে, এর পাঁচ বছর পরে অফিসের কাজে নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলাম। আকাশচুম্বী টুইন টাওয়ার যেখানে ছিল, এখন সেখানে স্মৃতিসৌধ, যার পোশাকি নাম গ্রাউন্ড জ়িরো। সেখানে কালো মার্বেলের উপরে খোদাই করা হাজারেরও বেশি নাম, ৯/১১-য় নিহতদের মধ্যে যাঁদের শনাক্ত করা গিয়েছে, তাঁদের। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সেই সব নামগুলো পড়লাম— একটি বিশেষ নামের খোঁজে— ‘রবার্ট জনসন’। জানি, এক হাজারের বেশি নিহতকে এখনও শনাক্ত করা যায়নি। তাঁদের মধ্যে থাকতেই পারেন সেই মধ্যবয়স্ক মানুষটি, শেষ মুহূর্ত আসন্ন বুঝতে পেরে যিনি আঁকড়ে ধরে ছিলেন অপরিচিত এক কণ্ঠস্বর।

মন মানতে চায় না। শুনেছিলাম, পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষকে টুইন টাওয়ারের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। তাঁরা অনেকেই গুরুতর জখম হয়েছিলেন, সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন, কিন্তু প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। এমনও তো হতে পারে, শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা গিয়েছিল রবার্টকে। তিনিও ফিরে যেতে পেরেছিলেন তাঁর স্ত্রী-কন্যার কাছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement