মোয়জ্জেম খান।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন বৃদ্ধির সঙ্গে রাস্তায় কমছিল গাড়ির সংখ্যা। দেশ ছাড়তে বাস-ট্রেন পেতে পড়ুয়াদের চালাতে হচ্ছিল আর এক লড়াই। ওই কঠিন সময়ে এগিয়ে এসে যিনি পড়ুয়াদের ইউক্রেনের সীমান্ত পেরোতে সাহায্য করেছেন তাঁর নাম মোয়জ্জেম খান। বছর ২৮-এর মোয়াজ্জেম পাকিস্তানের নাগরিক। তাঁর কথায়, ‘‘ওরা তো সবাই আমার ভাই-বোন। ওদের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করাকে সাহায্য বলতে লজ্জা লাগছে। আমি পাকিস্তানি বলে কোনও ভারতীয়কে সাহায্য করব না এতটা অশিক্ষিত, ছোট মনেরও হওয়া উচিত নয়।’’
হাজার খানেক ভারতীয় পড়ুয়াকে গাড়ির ব্যবস্থা করে বাড়ি ফিরতে সাহায্য করলেও মোয়াজ্জেমের বৌদি-সহ ভাইপো, ভাইঝিরা আটকে রয়েছেন রুশ হামলায় বিধ্বস্ত পূর্ব ইউক্রেনের সুমিতে। দাদা রয়েছেন কিভের কাছে। আর মোয়াজ্জেম রয়েছেন পশ্চিম ইউক্রেনের টর্নোপিল শহরে।
গ্রিন করিডর ছাড়া এখন সুমি থেকে বেরনো সম্ভব নয়। বৌদিদের কাছে খাবার আছে। পরিস্থিতি একটু উন্নতি হলে উদ্ধার করে পোল্যান্ড পাঠানো বা পশ্চিন ইউক্রেনের কোনও শহরে নিয়ে আসার চেষ্টা চালাবেন, বলে ফোনে জানালেন মোয়াজ্জেম।
গত এক দশক ধরে ইউক্রেনে পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মোয়াজ্জেম। সেই সূত্রে বেশ কিছু ভারতীয় পড়ুয়ার সঙ্গে আলাপ ছিল বলে জানান। ‘‘পড়ুয়াদের একটা দলকে সীমান্তে পৌঁছতে সাহায্য করার পর আমার ফোন নম্বর ছড়িয়ে পড়ে। দিনরাত গাড়ির জন্য ফোন আসতে থাকে। পরে যাঁরা গাড়ি পাচ্ছিলেন না তাঁদের জন্য থাকার ব্যবস্থাও করতে থাকি। অসময়ে ১৮-১৯ বছরের ভাই বোনদের একা ছাড়ব কোন বিবেকে’’— বললেন ২৮ বছরের যুবক।
অপরিচিত এত জনকে বাড়ি ফিরতে সাহায্য করলেও দাদার পরিবারকে কবে নিরাপদ জায়গায় আনতে পারবেন, সেই চিন্তায় ঘুম উড়েছে মোয়াজ্জেমের।
সাহায্যের জন্য প্রথম কবে ফোন এসেছিল, তারিখটা চট করে মনে করতে পারলেন না। তবে ঘটনাটা জানালেন। তখন ইউক্রেনে রুশ হামলার আশঙ্কায় বিমানবন্দরে ভিড় বাড়ছিল। ওই সময় চার পাঁচ জন ভারতীয় পড়ুয়া বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারেন তাঁদের বিমান বাতিল হয়ে গিয়েছে। হিমাঙ্কের নীচে তাপমাত্রার দাঁড়িয়ে তাঁরা তখন গাড়ির জন্য ফোন করেন। তাঁদের অবস্থান দেখে মোয়াজ্জেম বুঝতে পারেন তাঁর থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে রয়েছেন ওই পড়ুয়ারা। মোয়াজ্জেমের পক্ষে গাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ‘‘ইন্টারনেটে ওই এলাকায় গাড়ি, দোকান, হোটেল সবার ফোন নম্বর খুঁজে ফোন করতে থাকি। অর্ধেক শহরকে সে দিন আমি ফোন করে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিলাম’’, বললেন তিনি। অবশেষে গাড়ি ঠিক করে ওই পড়ুয়াদের নিরাপদ জায়গায় পাঠান তিনি। পরের দিন সকাল থেকেই রুশ আগ্রাসন শুরু হয়ে যায়। ‘‘ওই দিন আমার দাদা টর্নোপিল এসেছিল। হামলা শুরু হতে ও বৌদিদের জন্য সুমির উদ্দেশে রওনা দেয়। কিন্তু বাড়ি পৌঁছতে পারেনি’’, বললেন মোয়াজ্জম।
পর্যটন ব্যবসার জন্য বাস এবং ট্যাক্সি রয়েছে তাঁর। সেই গাড়িই পড়ুয়াদের ইউক্রেন থেকে বার করতে কাজে লাগান। কাজে লাগান ইউক্রেনে ব্যবসা সূত্রে গড়ে ওঠা যোগাযোগও। কত জন সাহায্যের জন্য ফোন করেছেন বা কত জনকে সাহায্য করতে পেরেছেন তার হিসাব রাখেননি। ঠিক যেমন এই কাজে কত খরচ হয়েছে তারও হিসাব করেননি তিনি। ভেবে বললেন, ‘‘গত ১৫ দিনে বিভিন্ন দেশের হাজার তিনেক মানুষকে তো সাহায্য করেছিই। এঁদের সিংহ ভাগই সীমান্ত পেরিয়ে গিয়েছেন। তার মধ্যে ৮০ শতাংশই ভারতীয়।’’ প্রথমে গাড়ি দিয়ে শুরু হলেও পরে খাবার, থাকার ব্যবস্থা করেও সাহায্য করেন তিনি। মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘কত খরচ হয়েছে তার হিসাব করছি না, বেঁচে থাকলে আবার উপার্জন করে নেব। আমার লক্ষ্যই ছিল কাউকে ১ শতাংশ সাহায্য করতে পারলে সেটা করব।’’
মোয়াজ্জেমের সাহায্য নিয়ে গত ৭তারিখ ইউক্রেন থেকে ঝাড়খণ্ডের বাড়িতে ফিরেছেন মনমিত কুমার। তাঁর মতে ‘খান ভাই’ না থাকলে সময় মতো সীমান্তে পৌঁছতে পারতেন কি না সন্দেহ। ভারতীয় পড়ুয়া, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির কাছে গত কয়েক দিনে মোয়াজ্জেম খান হয়ে গিয়েছেন ‘খান ভাই’।
মনমিত বললেন, ‘‘ওই সময় ইউক্রেনে সব কাজেই বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছিল। কিন্তু, বাসের জন্য আমাদের কাছ থেকে টাকাও চাননি খান ভাই।’’
বছর তিনেক আগে মোয়াজ্জেমের পর্যটন সংস্থার সঙ্গে ইউক্রেন ঘুরে ছিলেন মনমিত। কিভের বোগোমলেটস ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ষষ্ঠ বর্ষের ছাত্রের কথায়, ‘‘সেই সময়ও ও আমাদের সঙ্গে দেশ নিয়ে আলোচনা করছিল, তখন ওর কথাগুলো সিনেমার সংলাপের মতো মনে হচ্ছিল। তিন বছর পর যে খান ভাই সেটা প্রমাণ করে দেখাবে ভাবতে পারিনি। ভাগ্যিস ওর ফোন নম্বরটা মুছে ফেলিনি। তা হলে আর স্লোভকিয়া সীমান্তে যাওয়ার বাস পেতাম না।’’
২৮ ফেব্রুয়ারি মনমিতদের ১৭ জনের একটি দল ট্রেনে পোল্যান্ড সীমান্তে পৌঁছনোর জন্য রওনা দিয়েছিল। পরে বুঝতে পারেন কার্ফুর মধ্যে বাইরে থাকা নিরাপদ নয়। কৃতজ্ঞ মনমিত বললেন, ‘‘ট্রেন টার্নোপিলের উপর দিয়ে যাবে জেনে খান ভাইকে বাসের জন্য ফোন করি। এক কথায় ও রাজি হয়ে গেল। স্টেশনে নেমে দেখি আমাদের জন্য বাস দাঁড়িয়ে আছে।’’ সেই সময় ১৭ জনের বাস ভাড়া দেওয়ার মতো নগদ ছিল না তাঁদের কাছে। খান ভাইও আমাদের কাছে পুরো টাকা চাননি। যদিও পরে পুরো টাকাই ট্রান্সফার করে দেন মনমিত।
কিছু পাওয়ার আশায় বা সাতপাঁচ ভেবে এই সব করেননি বলে জানিয়ে মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘বিদেশের মাটিতে তো পাকিস্তান আর ভারতীয়দের মধ্যে কোনও সীমান্ত নেই। আমি ভারতীয় শিক্ষকের কাছে পড়াশোনাও করেছি। কিছু ঘটনা ভারত পাকিস্তানকে আলাদা করে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ইতিহাস নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। ইউক্রেনে আমরা ট্রেনে চেপে ভারতীয় কোনও বন্ধুর বাড়ি চলে যেতে পারি, ওরাও আমাদের বাড়ি আসে। দুই দেশের সম্পর্ক এই রকম হলে কত ভাল হত। দেশেও যখন তখন বাসে ট্রেনে চেপে বন্ধুর বাড়ি চলে যাওয়া যেত।’’
পাকিস্তানের তারবেলা শহরে বাড়ি মোয়াজ্জেমের। ‘‘আফসোস হয় যে দুই দেশের নাগরিকরা বিদেশে বেড়াতে আসেন কিন্তু একে অন্যের দেশে বেড়াতে যান না। কত সুন্দর সুন্দর বেড়ানোর জায়গা আছে পাকিস্তানে। এখানে এলে এত ভালোবাসা পাবেন যে ভুলতে পারবেন না। আমার তো ইচ্ছা করে আগরার তাজমহল দেখতে। বন্ধুদের নিয়ে গোয়ায় আনন্দ করতে। পুরনো এক বন্ধু থাকে চেন্নাইয়ে। ভারতে যেতে পারলে ওর বাড়িতেও এক বার ঘুরে আসব’’— ইতিহাস, কাঁটাতার সবকিছুকে আদৃশ্য করে দিয়ে বললেন মোয়াজ্জেম।
সীমান্ত পেরনোর পর ভারতীয় পড়ুয়ারা ফোনে, মেসেজে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বা়ড়ি ফেরার পর তাঁদের মা-বাবাও ফোন করে আশীর্বাদ করেছেন। বাড়িতে যাওয়ার নেমন্তন্ন করছেন। ‘‘ওখানে যাওয়ার আমার এত ইচ্ছা যে কিছু নেমন্তন্ন আমি যেচেই নিয়ে নিয়েছি’’, হাসতে হাসতে বললেন মোয়াজ্জেম।
কিন্তু যিনি অন্যদের এত সাহায্য করছেন তিনি কেন নিজের পরিবারকে সুমি থেকে উদ্ধার করে আনলেন না? হঠাৎ পরিস্থিতি যে এতটা বদলে যাবে তা বুঝতে পারেননি বলে জানালেন মোয়াজ্জেম। তাঁর কথায়, ‘‘ক্ষেপাণস্ত্রের আঘাতে কিভ-মস্কো হাইওয়েতে একটি ব্রিজ ভেঙে গিয়েছে। তার উপর ক্রমাগত শেলিং বাঁচিয়ে দাদার পক্ষেও সুমিতে পৌঁছনো অসম্ভব। দুই বাচ্চাকে নিয়ে বৌদিরও টর্নোপিল আসাও সম্ভব নয়। ইশ্বরের কাছে দোয়া করছি যাতে ওরা নিরাপদে থাকা। আপনারাও দোয়া করুন।’’ আবেদন করছেন ‘খান ভাই’।