চিয়াং লিন
তিন দশক ধরে তিনি চুপ করেই ছিলেন।
তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে ছাত্র-বিক্ষোভ মাটিতে মিশিয়ে দিতে বেজিংয়ে চিনা সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের রাতটা চাক্ষুষ করেছিলেন চিয়াং লিন। ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’-র (পিএলএ) প্রাক্তন এই সাংবাদিকের বয়স এখন ৬৬। ১৯৮৯ সালের ৪ জুনের রাতটা তবু তাড়া করে বেড়ায় চিয়াংকে। তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে অন্ধকারের মধ্যে গুলি চলার শব্দ, রক্তস্রোতে ভেসে যাওয়া শরীরগুলো— আর তার মধ্যে হঠাৎ তাঁর নিজের মাথায় নেমে আসা আঘাত। লুটিয়ে পড়া মাটিতে।
সেই সময়ে চিয়াং পিএলএ-র লেফটেন্যান্ট পদে। চিনা সেনার অভিযানের খুঁটিনাটি যেমন জানতেন, তেমনই দেখেছিলেন পিএলএ-র অন্দরে থেকেও গণতন্ত্রকামী প্রতিবাদীদের উপরে নির্যাতনের পরিকল্পনায় যাঁরা সায় দেননি, তাঁদের অসহায়তা। একের পর এক ছাত্রের বন্দি হওয়া, হত্যার চিহ্ন মুছে ফেলার কঠোর প্রয়াস— সব দেখেও চুপ করেছিলেন চিয়াং। কিন্তু ভিতরে ভিতরে যন্ত্রণার পাহাড়।
আগামী ৪ জুন তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে সেনা অভিযানের ৩০ বছর। চিয়াং ঠিক করেছেন, এ বার কথাগুলো বলতেই হবে। তিনি বলেছেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়েও চিনা কমিউনিস্ট পার্টির কোনও নেতা (প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-সহ) সেই ভয়ঙ্কর নিপীড়নের জন্য কোনও দুঃখপ্রকাশ করেননি। এ সপ্তাহে চিন ছেড়ে আসার আগে বেজিংয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘৩০ বছর ধরে যন্ত্রণাটা কুরে কুরে খেয়েছে। যাঁরা ওই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের উচিত, কী হয়েছিল সেটা প্রকাশ্যে এসে বলা।’’
সাত সপ্তাহ ধরে যাঁরা তিয়েনআনমেন স্কোয়ার দখল করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন, সেই বিশাল সংখ্যক ছাত্রের উপরে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিল সেনা। তিরিশ বছর পেরিয়েও তিয়েনআনমেন নিয়ে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ নয় বেজিং প্রশাসন। নিরপরাধ ছাত্র ও সাধারণ নাগরিকদের উপরে গুলি চালানো যে ভুল ছিল— সেটুকু বলার জন্য চাপ তৈরি করা হলেও চিনা কমিউনিস্ট পার্টি তাতে কান দেয়নি। তবে পার্টির চাপ থাকলেও চিনা ইতিহাসবিদ, লেখক, চিত্রশিল্পী, এবং চিত্রগ্রাহকদের ছোট কিছু গোষ্ঠী চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে এই অধ্যায়টিকে না-ভোলার। কিন্তু প্রকাশ্যে এসে চিয়াংয়ের নৈঃশব্দ ভাঙার আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। তিনি শুধু পিএলএ-র সদস্য ছিলেন না, তাঁর বাবা ছিলেন জেনারেল। সেনাবাহিনীর চত্বরেই তাঁর বেড়ে ওঠা। চিয়াং কোনও দিন ভাবেননি, সেনা নিরস্ত্র মানুষের উপরেও গুলি চালাতে পারে! তাঁর কথায়, ‘‘ট্যাঙ্ক নিয়ে তুমি তোমার দেশের মানুষের উপরে চড়াও হলে...। এটা উন্মত্ততা ছাড়া কিছু নয়।’’
সেই দিনটায় সাইকেল চড়ে সাধারণ পোশাকে বেরোন চিয়াং। খবর জোগাড় করতে। জানতেন সেনা অজান্তে তাঁর উপরেও চড়াও হতে পারে। তবু পরিচয় দেবেন না বলেই ঠিক করেছিলেন। গুলি আর ট্যাঙ্কের গোলার শব্দে তখন বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। মাঝরাত্তিরে চিয়াং তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে ঢুকতে যান। তাঁকে দেখেই ধেয়ে আসে ১২ জনেরও বেশি পুলিশ। মাথায় তখনই বৈদ্যুতিক লাঠির খোঁচা। ঘাড় বেয়ে নামছে রক্ত — এইটুকু অনুভূতি নিয়ে মাটিতে পড়ে যান চিয়াং। তখনও সেনার কার্ড তিনি বার করেননি। পরে নিজেকে বলেছিলেন, ‘‘আমি আজ আর লিবারেশন আর্মির সদস্য নই। সাধারণ মানুষ।’’ হাসপাতালে শুয়ে অসংখ্য মুখ দেখেছিলেন, সেনার অত্যাচারে দীর্ণ। রাতটা পাল্টে দিয়েছিল চিয়াংকে।
১৯৮৯-এর পরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আটকও করা হয়েছিল। এই সব নিয়ে একটা স্মৃতিকথা লেখার অপরাধে। ’৯৬-এর পর থেকে তিনি অন্তরালেই। শুধু ভেবেছেন, পার্টি ওই রক্তস্রোতের প্রায়শ্চিত্ত না করলে চিনের স্থিতিশীলতা বা উন্নতিতেও চিড় ধরবে। তাঁর মতে, ‘‘সবটাই বালির উপরে দাঁড়িয়ে আছে। কোনও শক্ত ভিত নেই। যদি মানুষকে মেরে ফেলার কথা অস্বীকার করা হয়, তা হলে যে কোনও মিথ্যেই বলা সম্ভব।