১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল উত্তর অতলান্তিক মহাসাগরে এক হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায় আরএমএস টাইটানিক। ১৯৮৫ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠের ৩.৮ কিলোমিটার গভীরে সেই জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। এর পর সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে প্রত্নসন্ধান শুরু হয়। বহু বিচিত্র জিনিসের সঙ্গে উঠে আসে অসংখ্য ঘড়ি।
ঘড়ির ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে জানা যায়, হাতঘড়ি প্রথম তৈরি হয় ১৯১২ খ্রিস্টাব্দেই। নেপলসের রানির জন্য সেটি তৈরি করা হয়েছিল। সুতরাং জলে নিমজ্জিত টাইটানিক থেকে যে ঘড়িগুলি উদ্ধার করা হয়, সেগুলি ছিল পকেট ঘড়ি।
টাইটানিক থেকে তুলে আনা ঘড়িগুলির সব ক’টিই যে জাহাজের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল, এমন নয়। বেশ কিছু ঘড়ি পাওয়া যায় জাহাজের ধ্বংসাবশেষের কাছকাছি অথবা বেশ খানিকটা দূরেও। এর কারণ, ঘড়ির মালিকরা অনেকেই ডুবন্ত জাহাজ থেকে ‘বাঁচতে’ ঝাঁপ দিয়েছিলেন সমুদ্রে। তার পর হিমশীতল জলে ঠান্ডায় জমে তাঁরা মারা যান।
লাইফবোটে ভেসে পড়া যাত্রীদের অনেকেই জলে পড়ে প্রয়াত হন। তাঁদের সঙ্গে তাঁদের পকেটে থাকা ঘড়িগুলিও সলিল সমাধি লাভ করে।
অনেক যাত্রী ডুবন্ত জাহাজ ত্যাগ করেননি। জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে ডেক-এ দাঁড়িয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপক্ষা করেন। বলাই বাহুল্য, সেই সব যাত্রীর অনেকের পকেটেও ছিল নানা কিসিমের ঘড়ি।
জাহাজের অবশেষ অথবা তার কাছে-দূরে পাওয়া ঘড়িগুলি মাইনাস ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার জলে পড়া মাত্রই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ধরে নেওয়া যায়। লক্ষণীয়, ১৯৮৫ সালের পরে উদ্ধার হওয়া সেই সব ঘড়ির একেকটির বন্ধ হওয়ার সময় ছিল অন্যটির থেকে আলাদা।
টাইটানিকের সঙ্গে হিমশৈলের ধাক্কা লাগে রাত ১১টা ৪০ মিনিট নাগাদ। পরের আধ ঘণ্টা কাটে আতঙ্কের চরিত্র বুঝতে। তারও ৪০ মিনিট পরে শুরু হয় জাহাজ ত্যাগ। জানা যায়, শেষ লাইফবোটটি জাহাজ ছাড়ে রাত ২টো ৫ মিনিটে।
উদ্ধার হওয়া অধিকাংশ ঘড়ির কাঁটা সেই কারণেই রাত আড়াইটের পর থেকে থমকে যেতে শুরু করে। টাইটানিক বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে কৌতূহলী মানুষ— এই বন্ধ হওয়া ঘড়িগুলি থেকেই অনুমান করতে পারেন তাদের মালিকদের শেষ মুহূর্তের ভয়াবহ অবস্থার কথা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে টাইটানিক নিয়ে কৌতূহল। বিশেষ করে, ১৯৯৭ সালে জেমস ক্যামেরনের পরিচালনায় ‘টাইটানিক’ ছবিটি মুক্তি পেলে বিশ্ব জুড়ে শুরু হয় টাইটানিক-ম্যানিয়া। সংবাদ শিরোনামে উঠে আসতে থাকে সেই সব বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়ির কথাও।
পশ্চিমের, বিশেষ করে আমেরিকার নিলামঘরগুলিতে টাইটানিক স্মারক কেনার হিড়িক শুরু হয় তার পর থেকেই। বিপুল দামে বিভিন্ন সামগ্রীর সঙ্গে নিলামে উঠতে থাকে ঘড়িগুলিও।
২০২০-র ডিসেম্বরে নিউ জার্সির গোল্ডিন অকশনস-এ নিলামে ওঠে টাইটানিকের সেকেন্ড অফিসার চার্লস এইচ লাইটোলারের পকেট ঘড়ি। ঘড়িটি ১৬৯,২০০ মার্কিন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা) মূল্যে কিনে নেন আমেরিকান ধনকুবের জন মিয়োট্টেল। লাইটোলার অবশ্য সেই জাহাজ থেকে বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন।
জন মিয়োট্টেলের সংগ্রহে রয়েছে মোট ৬টি ‘টাইটানিক’ ঘড়ি। তাদের মালিকরা ছিলেন আমেরিকান ডাকবিভগের কর্মী অস্কার উডি, টাইটানিক উদ্ধারে এগিয়ে আসা জাহাজ ‘কার্পেথিয়া’-র ক্যাপ্টেন আর্থার রোস্ট্রন, কার্পেথিয়া-র বেতারকর্মী হ্যারল্ড কোট্টাম, টাইটানিকের তৃতীয় শ্রেণির দরিদ্র যাত্রী সিনাই কন্টোর এবং টাইটানিকের সব থেকে ধনী যাত্রী চতুর্থ জন জ্যাকব অ্যাস্টর।
সংগ্রাহক মিয়োট্টেল জানিয়েছেন, প্রতিটি ঘড়িই স্বকীয় মহিমায় ভাস্বর। যেমন লাইটোলারের ঘড়িটি একেবারেই কাজের ঘড়ি, বাহুল্য বর্জিত। অন্য দিকে অ্যস্টরের ঘড়িটি দামি এবং শৌখিন। ডাক-কর্মীর ঘড়িতে ইহুদি পুরাণপুরুষ মোজেসের ছবি আঁকা ছিল।
তবে মিয়োট্টেলের মতে, তঁর সংগ্রহের মধ্যে লাইটোলারের ঘড়িটিই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে সময় সেটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেটিই ছিল আরএমএস টাইটানিকের সব থেকে ভয়ঙ্কর মুহূর্ত।
বেশ কিছু সংগ্রহশালায় রাখা আছে টাইটানিক থেকে তুলে আনা সামগ্রী। রাখা আছে বেশ কিছু ঘড়িও। তাদের ঘিরে আবার পল্লবিত হয়েছে অতিপ্রাকৃত সব কাহিনি। আজও নাকি অনেক ‘ঘড়ির মালিক’ ফিরে আসেন নিশুত রাতে সেই সব সংগ্রহশালায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তাঁদের ছেড়ে যাওয়া সময়-মাপকের সামনে। সময় সেখানে থমকে আছে আর প্রেতলোকে থমকে আছেন তাঁরা।