রাজ্যে শেষ দফার ভোটে কমবেশি দেড় হাজার বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিলেন বিরোধীরা। নির্বাচন কমিশন বুধবার জানিয়ে দিল, পাঁচটি বুথে বৃহস্পতিবার পুনরায় নির্বাচন হবে। তবে এর মধ্যে হাড়োয়ার ব্রাহ্মণচক বা বারাসতের কামদুনি নেই।
যে পাঁচটি বুথে আবার ভোট নেওয়া হবে, সেগুলি হল হাড়োয়া বিধানসভা এলাকার ১৪৫ নম্বর, দক্ষিণ বারাসত বিধানসভা এলাকার ২৫৩ নম্বর, অশোকনগর বিধানসভা এলাকার ৮২ নম্বর, ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা এলাকার ২২৫ ও ২২৬ নম্বর বুথ। ভোটগ্রহণ হবে সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।
প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম বুথে পুনর্নির্বাচন ঘোষণা হওয়ার জন্য তো বটেই, বিশেষত হাড়োয়ার ব্রাহ্মণচক এবং কামদুনির বুথে পুনর্নির্বাচন না দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিরোধীরাা। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, ব্রাহ্মণচকে তারা পুনর্নির্বাচন প্রস্তাবই করেনি। কিন্তু কামদুনিতে করেছিল। কমিশনই সেই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছে।
কী ঘটেছিল ব্রাক্ষ্মণচক ও কামদুনিতে?
বসিরহাট লোকসভার হাড়োয়ার ব্রাহ্মণচকে ভোটের দিন গুলি চলেছিল। তৃণমূল-সিপিএমের সংঘর্ষে দু’পক্ষের ২২ জন আহত হন সেদিন। উস্কানির মূল অভিযোগ ছিল মিনাখাঁর তৃণমূল বিধায়ক ঊষারানি মণ্ডল ও তাঁর স্বামী মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে সোমবার বিকেলে নিজে ওই বুথে ছুটে গিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক সুধীরকুমার রাকেশ। ৩০০-র বেশি গ্রামবাসী তাঁকে ঘিরে ধরে অভিযোগ জানান, তাঁরা ভোট দিতে পারেননি। পুলিশি নিরাপত্তায় গ্রামবাসীদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বাস দেন রাকেশ। গ্রামবাসীরা সেই আবেদন ফিরিয়ে দিয়ে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু এ দিন কমিশনের বক্তব্য, ব্রাহ্মণচকে যেখানে সংঘর্ষ হয়েছিল তা ভোটকেন্দ্র থেকে অনেক দূরে। তাই সেখানে ফের ভোটের দাবি খারিজ করা হয়েছে।
কামদুনির বুথে ইভিএম খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সে সময় ক্যামেরায় ধরা পড়ে, প্রিসাইডিং অফিসারের চেয়ারে বসে আছেন তৃণমূলের পোলিং এজেন্ট। পাশের একটি ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন প্রিসাইডিং অফিসার। এই ছবির সিডি পাঠিয়ে জেলা প্রশাসন ওই বুথে পুনর্নির্বাচনের সুপারিশ করেছিল। কমিশন তা নাকচ করে দিয়েছে।
কেন? কমিশন সূত্রে বলা হয়েছে, কামদুনিতে যে তৃণমূল নেতার নামে ভোটকেন্দ্রের ভিতরে ঢোকার অভিযোগ উঠেছিল তিনি ওই দলেরই নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন। সিসিটিভির ছবিতে তাঁর বিরুদ্ধে আইন ভাঙার তেমন কোনও অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ভোটযন্ত্র খারাপ হওয়ায় ওই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ পর্ব কিছুক্ষণ বন্ধ ছিল। গাফিলতির অভিযোগ ওঠার পরে প্রিসাইডিং অফিসারকে সরিয়ে দিয়েই ভোটগ্রহণ হয়। কামদুনিতে তাই আর পুনর্নির্বাচন দেওয়া হয়নি।
যে পাঁচটি বুথে পুনর্নির্বাচন ঘোষণা করা হল, সেগুলো কীসের ভিত্তিতে বাছা হয়েছে? উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক ওঙ্কারসিংহ মীনা এ দিন বলেন, “জেলায় তিনটি বুথে ভোটযন্ত্র খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাই ফের ভোট হবে।” ক্যানিংয়ে জীবনতলার দু’টি বুথে তৃণমূল কর্মীরা ভোটারদের প্রভাবিত করছেন, এমন ছবি সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল। তাই ওই দুই বুথে পুনরায় নির্বাচনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিশনের এক অফিসার।
বিরোধীরা অবশ্য এতে খুশি নন। ভোট গণনা শুরু হতে আর এক দিন বাকি। তবু পুনর্নির্বাচনের দাবিতে ফের এ দিন দিল্লিতে সরব হল কংগ্রেস ও সিপিএম শিবির। দিল্লির যন্তরমন্তরে বামেরা এ দিন পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়ে ধর্নায় বসেন। আবার একই দাবিতে কমিশনের দ্বারস্থ হন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পতের সঙ্গে দেখা করে অধীরবাবুর অভিযোগ, “বিশেষ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ভোটের আগে বড় বড় কথা বললেও আসল সময়ে উধাও হয়ে ছিলেন। এই ঘটনায় আখেরে রাজ্যের মানুষের কাছে কমিশনের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হয়েছে।” পঞ্চম দফার ভোটে ১১৬৫টি বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানান তিনি।
কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এ দিন বাম শিবিরেরও দাবি, এ বারের ভোটে কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আজ যন্তরমন্তরে ধর্নাস্থল থেকে প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরিরা দাবি করেন, কমিশনের কাছে পাঁচ দফা মিলিয়ে ৩৩০০-র বেশি বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছিল। এর মধ্যে শেষ দফাতেই ছিল প্রায় দেড় হাজার বুথ।
কলকাতাতেও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এ দিন মন্তব্য করেন, “পর্যবেক্ষকেরা এ রাজ্যের অসহায় মানুষকে শাসক দলের হিংস্র আক্রমণের মুখে ছেড়ে দিয়েছেন। এখন হাসি হাসি মুখ করে নায়ক-নায়ক ভাব দেখাচ্ছেন!”
পাশাপাশি বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র দাবি করেন, দেড় হাজারের বেশি বুথে গোলমাল হয়েছে। ক্যামেরায় তোলা ছবি, সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট এত কিছুর পরেও পুনর্নির্বাচনের নির্দেশের জন্য আর কী দরকার, প্রশ্ন সূর্যবাবুর।
কমিশনের কাছে শেষ দফার ৬০০টি বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি করেছে রাজ্য বিজেপি-ও। তবে বিরোধীদের দাবিকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছে তৃণমূল। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের বক্তব্য, বিরোধীদের পায়ের তলার মাটি নেই বলেই তারা এমন অভিযোগ করছে ও তাতে বাংলার মানুষকে অপমান করা হচ্ছে।
এখন বিজেপি এবং কংগ্রেস আশঙ্কা করছে, ভোটগণনার দিন রাজ্য জুড়ে শাসক দল সন্ত্রাস চালাতে পারে। দিল্লিতে উপ-নির্বাচন কমিশনার বিনোদ জুৎসিকে এ দিন এই আশঙ্কার কথা লিখিত ভাবে জানিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচার কমিটির চেয়ারম্যান তথা প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও জানিয়েছেন, তাঁরা গণনাকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে চিঠি দিয়েছেন।