সারদায় একসুর সনিয়া, মোদী

হিম্মত থাকলে ধরুন, ফের চ্যালেঞ্জ মমতার

আজ, বুধবার সুপ্রিম কোর্টে ওঠার কথা সারদা মামলার। সর্বোচ্চ আদালত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেবে কি না, তাই নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে জল্পনা এখন তুঙ্গে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যে প্রচারে এসে নাম না করে সারদা-অস্ত্রে তৃণমূলের সরকার তথা শাসক দলকে বিঁধলেন সনিয়া গাঁধী। একই দিনে এবিপি আনন্দকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সারদা-কাণ্ড নিয়ে যথাযথ তদন্তের দাবি তুলেছেন বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩২
Share:

আজ, বুধবার সুপ্রিম কোর্টে ওঠার কথা সারদা মামলার। সর্বোচ্চ আদালত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেবে কি না, তাই নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে জল্পনা এখন তুঙ্গে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যে প্রচারে এসে নাম না করে সারদা-অস্ত্রে তৃণমূলের সরকার তথা শাসক দলকে বিঁধলেন সনিয়া গাঁধী। একই দিনে এবিপি আনন্দকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সারদা-কাণ্ড নিয়ে যথাযথ তদন্তের দাবি তুলেছেন বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী।

Advertisement

কংগ্রেস এবং বিজেপি, দুই সর্বভারতীয় দলের দুই প্রধান কাণ্ডারী একই হাতিয়ারে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করছেন এমন ঘটনা এই প্রথম ঘটল। সারা দেশে কংগ্রেস এবং বিজেপি পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সেখানে রাজ্যে দুই নেতানেত্রীর এ ভাবে মমতার সরকারকে বিদ্ধ করাটা তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। সম্প্রতি রাজ্যে এসে কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধীও সারদা প্রসঙ্গে রাজ্য সরকার ও শাসক দলকে আক্রমণ করেছিলেন। শিলিগুড়ির সভায় মোদীও সারদা-কাণ্ড তুলেছিলেন। সেই ধারা বজায় রইল এ দিনও। এর সঙ্গে যোগ হল বাম নেতাদের তীব্র কটাক্ষও।

ত্রিমুখী এই আক্রমণ সামলাতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য ‘আক্রমণই আত্মরক্ষার সেরা উপায়’ আপ্তবাক্যকেই কৌশল করেছেন। এক দিকে যেমন তিনি ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ বলে বিরোধীদের পাল্টা কটাক্ষ করেছেন, তেমনই বিগত বাম সরকারের ঘাড়ে বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার (যাকে চিট ফান্ড বলে উল্লেখ করেছেন সনিয়া-মোদী) রমরমার যাবতীয় দায় চাপিয়ে দিয়েছেন। ফের তুই-তোকারির পর্যায়ে গিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ, হিম্মত থাকলে তাঁকে গ্রেফতার করা হোক!

Advertisement

এই চাপানউতোরের মধ্যে সম্ভবত আজই সারদা মামলা নিয়ে রায় শোনাবে সুপ্রিম কোর্ট। সর্বোচ্চ আদালত শেষ পর্যন্ত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেবে, আশা করে রয়েছেন বিরোধীরা। তৃণমূল শিবিরের তরফে অবশ্য ধারাবাহিক ভাবে দাবি করা হচ্ছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার ইডি-কে ব্যবহার করছে। বামেরা আবার প্রশ্ন তুলেছেন, বিগত সরকারই যদি দোষী হয়, তা হলে সিবিআই তদন্তে বর্তমান সরকারের এত আপত্তি কেন? এই ধরনের বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার দৌরাত্ম্য রুখতে কেন্দ্রীয় বিভাগগুলির সক্রিয়তার অভাব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বামেরা।

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাশমুন্সির সমর্থনে প্রচারে এসে মঙ্গলবার উত্তর দিনাজপুরের গোয়ালপোখরে সনিয়া বলেছেন, “কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমিক, কৃষক, শিশুদের জন্য একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এক-এক পয়সা বাঁচানোর জন্য আমরা কত কাজ করেছি।” এর পরেই কংগ্রেস সভানেত্রীর অভিযোগ, “কিন্তু রাজ্য সরকারের মদতে চিট ফান্ড ১৮ লক্ষেরও বেশি পরিবারের টাকা লুঠ করেছে। রাজ্যে আইনের যা অবস্থা, তা আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন! আইন বলতে কিছু নেই!”

সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্ত হওয়া উচিত কি না, এই প্রশ্নের জবাবে সাক্ষাৎকারে মোদী আবার বলেছেন, “এই চিট ফান্ডে এত গরিব মানুষের টাকা গিয়েছে, কিছু মানুষ আত্মহত্যাও করেছেন। এই পরিস্থিতিতে মানুষের ভরসা থাকে, এমন পদক্ষেপ তো করতেই হবে। কী ফোরাম হবে, না হবে, আলাদা বিষয়। কিন্তু মানুষের ভরসা থাকে, এমন পদক্ষেপই তো করা উচিত।”

সারদা নিয়ে তাঁর সরকার ও দল যখন এমন সাঁড়াশি চাপে, তখন পাল্টা আক্রমণের পথই নিতে চেয়েছেন মমতা। প্রশ্ন তুলেছেন, এই ধরনের সংস্থার বিজ্ঞাপন থেকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম কত টাকা পেয়েছিল? এর পাল্টা যুক্তিতে অবশ্য বলা হচ্ছে, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এ ধরনের সংস্থার কোনও বিজ্ঞাপনেই টাকা তোলার কথা থাকত না। বিজ্ঞাপন হতো তাদের বিভিন্ন পণ্যের। তাই সেই বিজ্ঞাপন নিতে কোনও বাধা ছিল না সংবাদমাধ্যমের। এই প্রসঙ্গে মমতা দাবি করেছেন, তৃণমূলের মুখপত্র এক পয়সাও নেয়নি। তিনি এ দিন আরও বলেছেন, “বরং আমরা সারদার কর্তাকে কাশ্মীর থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসি। চিট ফান্ড দেখার দায়িত্ব কেন্দ্রের। ভোট এসেছে বলে ইডি-কে পাঠিয়েছে। সারদার এফআইআরে চিদম্বরমের স্ত্রীর নাম আছে। কংগ্রেসের এক সাংসদ, তার আবার চোরের মায়ের বড় গলা! সে-ও বিশেষ ভাবে কুৎসা রটাচ্ছে!” বাঁকুড়ায় একটি এবং হুগলি জেলায় দু’টি সভা থেকেই তৃণমূল নেত্রী কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি’কে এক বন্ধনীতে ফেলে আক্রমণ করেছেন।

দল ও সরকারকে রক্ষা করতে মমতার সঙ্গে মুখ খুলেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ও। মালদহে তিনি বলেছেন, “তিন-চার দিন হল সনিয়া, রাহুল গাঁধীরা সারদা চিট ফান্ড নিয়ে সরব হয়েছেন। এটা গভীর চক্রান্ত! রাজ্যে ৯১টি চিট ফান্ড ব্যবসা করেছিল। তাদের অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার! আর সেই চিট ফান্ডকে বাড়তে সাহায্য করেছিল মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি!” মুকুলবাবুর আরও কটাক্ষ, “স্পেকট্রাম, কয়লা, কমনওয়েলথ কেলেঙ্কারি ইউপিএ চেয়ারপার্সন বা রাহুল গাঁধী জানেন না, এটা হতে পারে না! এত সব কেলেঙ্কারির টাকা কোথায় গেল? সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধী জবাব দিন!”

রাজ্য রাজনীতির লোকজন এ সব দেখেশুনে বলছেন, আদালতের নির্দেশে সারদা-কাণ্ডে ইডি সক্রিয় হওয়ায় এবং তদন্তে শাসক দলের নেতাদের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় ভোটের মুখে অস্বস্তিতে পড়েছে তৃণমূল। তাই বিড়ম্বনা সামাল দিতে তারা পাল্টা আক্রমণ করছে কংগ্রেস-সিপিএমকে। বিরোধীরা বলছেন, সারদার কাছ থেকে কে কতটা আর্থিক ভাবে লাভবান হয়েছেন, তা অবশ্যই তদন্তসাপেক্ষ। অতীতে ক্ষেত্রবিশেষে রবীন দেব, সুজন চক্রবর্তীর মতো সিপিএম নেতার নামও কখনও সখনও জড়িয়েছে। বাম জমানার অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের প্রাক্তন আপ্ত-সহায়ককে দল থেকে বহিষ্কারও করেছে সিপিএম। কিন্তু রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে তৃণমূল সরকার যে ভাবে প্রকাশ্যে সারদা গোষ্ঠীর সঙ্গে ওঠাবসা করেছে, তা আগে কারও ক্ষেত্রেই দেখা যায়নি বলেই সার্বিক ভাবে অভিযোগ বিরোধীদের। তাই বিপদে পড়ে তারা আরও বেশি করে পাল্টা আক্রমণ করছে।

সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার আগেই ২০১২-র ডিসেম্বরে চিট ফান্ডের রমরমা এবং রাজ্যের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে আঘাত নিয়ে বিধানসভায় মুলতবি প্রস্তাব এনেছিল বিরোধী বামেরা। শাসক বেঞ্চের প্রবল প্রতিবাদে সে দিন বিধানসভায় বচসা বাধে। শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষে আহত হন দুই সিপিএম বিধায়ক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায় ও দেবলীনা হেমব্রম। এখানেই শেষ নয়। জঙ্গলমহলের জন্য দেওয়া সারদা গোষ্ঠীর অ্যাম্বুল্যান্স উদ্বোধন করতে দেখা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

সুদীপ্ত সেন ধরা পড়ার পরে বন্ধ হতে বসা সারদার একটি বৈদ্যুতিন চ্যানেল চালানোর দায়িত্ব নেওয়ার কথা সরাসরি ঘোষণা করেছিল রাজ্য সরকারই। আইনি গেরোয় তা শেষ পর্যন্ত সম্ভব না হলেও সারদা-কাণ্ডের পরে বিপন্ন চ্যানেলের কর্মীদের আর্থিক সাহায্য করা হয়েছে। এমনকী, একটি চ্যানেল চালাতে এগিয়ে এসেছেন এক তৃণমূল নেতা।

এ সব উদাহরণই তুলে ধরছেন বিরোধী নেতারা। পাশাপাশি প্রশ্ন করেছেন, সারদার সঙ্গে রাজ্য সরকার তথা শাসক দলের ঘনিষ্ঠতা অস্বীকার করার জায়গা কোথায়?

বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, “ইডি এখনও বিশেষ কিছুই করেনি। তারা কান টেনেছে শুধু। আমরা চাইছি, কানের সঙ্গে মাথাও যাতে আসে!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement