বড় ভরসারাই হাতছাড়া! এনআরএস ছাত্রাবাসে পিটিয়ে খুনের কিনারা করার জন্য পুলিশ যাঁদের উপরে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করে ছিল, সেই পাঁচ প্রত্যক্ষদর্শী বেঁকে বসায় তদন্তকারীরা অথৈ জলে পড়ে গিয়েছেন। অন্য দিকে ঘটনার যথাযথ ও নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছেন নিহতের স্ত্রী।
পাঁচ জনের মধ্যে তিন জন এনআরএস হস্টেলের ক্যান্টিন-কর্মী। বাকি দু’জন নির্মাণকর্মী। ক্যান্টিনের তিন জন এখন মুখ খুলতে চাইছেন না। দুই নির্মাণকর্মী ঘটনার পরে সেই যে দেশের বাড়ি চলে গিয়েছেন, আর ফেরেননি। পুলিশ সেখানে গিয়েও ওঁদের সন্ধান পায়নি। তাই মূল অভিযুক্তদের নাগাল পেতে লালবাজারকে আপাতত এনআরএসের প্রথম বর্ষের ছাত্র জসিমুদ্দিনের উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু তিনিও তেমন সহযোগিতা করছেন না।
কোরপান শা নামে মানসিক প্রতিবন্ধী যুবকটিকে গত ১৬ নভেম্বর ভোরে এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের যে বয়েজ হস্টেলে পিটিয়ে মারা হয়েছিল, মালদহের চাঁচলের বাসিন্দা জসিমুদ্দিন গত দু’মাস যাবৎ সেখানকার আবাসিক ছিলেন। কোরপান-হত্যার তদন্তে নেমে পুলিশ গত মঙ্গলবার তাঁকে গ্রেফতার করে। আদালত জসিমুদ্দিনকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখতে বলেছে। আর উলুবেড়িয়ার বাসিন্দা কোরপানের স্ত্রী আর্জিনা বিবি এ দিন হাইকোর্টে যে মামলা দায়ের করেছেন, তাতে ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়াও তাঁর নিজের নিরাপত্তা ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আর্জিনার কৌঁসুলি জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়।
লালবাজারের দাবি: কোরপান হত্যাকাণ্ডের ওই পাঁচ প্রত্যক্ষদর্শী তদন্তকারীদের প্রথমে আশ্বাস দিয়েছিলেন, হস্টেলের সব আবাসিকের ছবি দেখতে পারলেই তাঁরা গণপিটুনিতে জড়িতদের চিনিয়ে দেবেন। কিন্তু ওঁরা আচমকা কেন বিগড়ে গেলেন, পুলিশ সেটাও যাচাই করছে। “আমরা দেখছি, জসিমুদ্দিনের মতো ওঁদেরও কেউ বা কারা ভয় দেখিয়েছে কি না।
আমাদের সন্দেহ, মূল অভিযুক্তদের আড়াল করছে যারা, সাক্ষী ভাঙানোর ছক তারাই কষছে।” মন্তব্য এক তদন্তকারীর।
প্রসঙ্গত, এনআরএস-কাণ্ডের জেরে নির্দোষ ছাত্রদের যাতে হেনস্থা হতে না হয়, সে জন্য ঘটনার পরেই রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তাকে চিঠি দিয়েছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। লালবাজারের একাংশের মতে, প্রত্যক্ষদর্শীদের বিগড়ে যাওয়ার পিছনেও শাসকদলের মদত থাকতে পারে। পুলিশ-সূত্রের খবর, অভিযুক্তদের চিহ্নিতকরণে সাহায্য করলে কাজ হারাতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শী। অন্তত তাঁদের বাড়ির লোকের কথাবার্তায় তেমনই আভাস মিলেছে। এক প্রত্যক্ষদর্শী তো পরিষ্কারই বলেছেন, “আমি কিছু দেখিনি। আমাকে এ সবের মধ্যে জড়াবেন না। খামোকা ফ্যাসাদে পড়তে চাই না।”
পাশাপাশি জসিমুদ্দিনও প্রায় একই সুরে গাইছেন। শুক্রবারও জেরার মুখে তিনি দাবি করেছেন, গণপিটুনিতে যুক্ত ‘দাদাদের’ তিনি চেনেন না। বৃহস্পতিবার জসিমুদ্দিনের বাবা ও কাকাকে লালবাজারে নিয়ে এসেছিল পুলিশ। অফিসারদের আশা ছিল, পরিজনদের দেখলে হয়তো তিনি ভেঙে পড়বেন। কিন্তু তা হয়নি। বাবার সামনেই বসেই জসিমুদ্দিন তদন্তকারীদের জানিয়ে দেন, কোরপানকে থামে বেঁধে যারা মারছিল, তাদের তিনি চেনেন না।
এমতাবস্থায় স্রেফ প্রত্যক্ষদর্শীর অভাবে পুলিশকে এই মুহূর্তে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। তদন্তকারীদের আক্ষেপ, অভিযুক্ত বেশ কিছু হবু ডাক্তারকে চিহ্নিত করা গেলেও প্রত্যক্ষদর্শী না-থাকায় তাঁদের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। গোয়েন্দা-সূত্রের খবর, অভিযুক্তদের অধিকাংশ এনআরএসের তৃতীয় বর্ষের ডাক্তারি-পড়ুয়া এবং সকলেই হস্টেলে জসিমুদ্দিনের আশপাশের বিভিন্ন ঘরের আবাসিক। লালবাজার সূত্রের খবর: হস্টেলের আবাসিকদের মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, ১৬ নভেম্বর সকালে বেশ কয়েক জনের ফোনে অস্বাভাবিক বেশি কল হয়েছিল। সেই সূত্র ধরেই কয়েক জনকে প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শিগগিরই তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানো হতে পারে বলে লালবাজারের ইঙ্গিত।
এ দিকে এনআরএসের ওই বয়েজ হস্টেলের উপরে সুরক্ষা-নজরদারি বেড়েছে। ফটকে এখন চব্বিশ ঘণ্টা দু’জন পুলিশকর্মীর মোতায়েন। গোটা এনআরএস চত্বরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও বাড়ানো হয়েছে।