সারদা-ঝড়ে বেসামাল দলের রাশ ধরলেন মমতা

সারদা-কাণ্ডে টালমাটাল দল সামলানোর ভার শেষ পর্যন্ত নিজের হাতে তুলে নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিবিআই তদন্তের ফাঁস যত দলের উপর চেপে বসছে, তৃণমূলের অন্দরে ততই গভীর হচ্ছে সঙ্কট। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল নেত্রী শনিবার কালীঘাটে দলের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রী ও বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানে মমতা জানিয়ে দিয়েছেন, এ বার থেকে তিনিই দলের কাজকর্ম দেখবেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৯
Share:

বৈঠক শেষ। নেত্রীর কালীঘাটের বাড়ি থেকে হাতে হাত ধরে বেরিয়ে আসছেন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। শনিবার। —নিজস্ব চিত্র।

সারদা-কাণ্ডে টালমাটাল দল সামলানোর ভার শেষ পর্যন্ত নিজের হাতে তুলে নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিবিআই তদন্তের ফাঁস যত দলের উপর চেপে বসছে, তৃণমূলের অন্দরে ততই গভীর হচ্ছে সঙ্কট। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল নেত্রী শনিবার কালীঘাটে দলের শীর্ষ নেতা, মন্ত্রী ও বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানে মমতা জানিয়ে দিয়েছেন, এ বার থেকে তিনিই দলের কাজকর্ম দেখবেন। দলের নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে তৃণমূল নেত্রী এ দিন ফের সারদা-কাণ্ডে অভিযুক্ত এবং ধৃত নেতা-মন্ত্রীদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন।

Advertisement

দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এ দিন বৈঠকে ছিলেন না। দলের অনেকে এটাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। মুকুল অবশ্য জানিয়েছেন, দিল্লিতে দলের কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি বৈঠকে থাকতে পারেননি। তাঁর কথায়, “আমি যে দলের কাজে দিল্লি এসেছি, এটা দলের সকলেই জানেন। এ নিয়ে জল্পনার কোনও অবকাশ নেই।” কিন্তু বৈঠকে মুকুলের অনুপস্থিতিতে মমতা যে ভাবে দলের ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন তা নিয়ে তৃণমূলের অন্দর থেকে দু’রকম ব্যাখ্যা শোনা গিয়েছে। এক, দলকে অস্বস্তিতে ফেলে, এমন কথাবার্তা বলা থেকে নেতাদের নিরস্ত করা। দুই, মুকুলের সঙ্গে সংগঠনের দূরত্ব বাড়ানো।

তৃণমূল নেতাদের একটি অংশের মতে, বিবেক দংশনে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা আজকাল প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেছেন নানা বিষয়ে। তাঁদের মন্তব্য, ভাবনা ও প্রতিক্রিয়া শাসক দলকে বিড়ম্বনায় ফেলছে। যাঁরা প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, তাঁরা কেউ মন্ত্রী বা সাংসদ অথবা গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রতিনিধি। বিবেকের চাপেও যাতে এ ভাবে কেউ মুখ না খোলেন, সেই জন্যই দলের রাশ নিজের হাতে তুলে নিলেন দলনেত্রী। কারণ, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিনি ছাড়া দলে আর কোনও ‘বিকল্প’ যে নেই, মমতা সেটা বিলক্ষণ জানেন।

Advertisement

মমতা এ দিনের বৈঠকে নির্দেশ দিয়েছেন, এক দফতরের মন্ত্রী যেন অন্য দফতরের ব্যাপারে কথা না বলেন। শিক্ষা দফতরের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সম্প্রতি তাঁর দফতরের কাজকর্ম নিয়ে সমালোচনা করে সরকার ও দলের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন দুই মন্ত্রী, সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও সাধন পাণ্ডে। মনে করা হচ্ছে, নাম না করেও ওই দু’জনকেই সতর্ক করে দিলেন মমতা। একই ভাবে দলের বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায়কেও এ দিন সতর্ক করেছেন দলনেত্রী।

তৃণমূল নেতৃত্বের অন্য অংশের মতে, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল সিবিআইয়ের নজরে রয়েছেন। দলে তাই মুকুলকে নিয়ে অস্বস্তি আছেই। দলের অধিকাংশ কর্মসূচিতেই তাঁর ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। গত মাসেই দুই মেদিনীপুরের কর্মিসভায় যেমন তাঁকে দেখা যায়নি, তেমনই দলের সদস্যকরণ কর্মসূচির দিনেই তৃণমূলের স্ক্রুটিনি কমিটির বৈঠকে মুকুল ছিলেন না। তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের ব্যাখ্যায়, সারদা নিয়ে সিবিআই তদন্ত যতই দলের ঘাড়ে চেপে বসছে, ততই দলের অন্দরে অ-মুকুলায়ন প্রক্রিয়াও জোরদার হচ্ছে। এত দিন সংগঠনের মূল চাবিকাঠি ছিল মুকুলের হাতেই। এই মূহূর্তে মুকুলের বিকল্প তৈরি হওয়া সম্ভব নয় জেনেই মমতা সংগঠনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। এ নিয়ে তাঁকে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তাঁর কথায়, “এই দলকে শক্তিশালী করার সময় অবশ্য মমতার হাতে আর থাকবে না। কারণ, সারদা-কাণ্ডে তাঁর দল এখন ডুবন্ত নৌকা।”

এ দিনের বৈঠকে আর এক উল্লেখযোগ্য অনুপস্থিতি তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। নন্দীগ্রামের ভূতারমোড়ে এ দিন বিকেলে

জমি আন্দোলনের সূচনার অষ্টম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান ছিল। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে শুভেন্দু বলেন, “কলকাতায় গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যোগ দিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, নন্দীগ্রামের আন্দোলন আমাকে পরিচিতি দিয়েছে, নন্দীগ্রামের মানুষ ভালবাসা দিয়েছেন। সেখানেই আগে যাওয়া দরকার।”

মুকুলহীন বৈঠকেও অবশ্য তাঁর কথা টেনে এনেছেন দলনেত্রী। সারদা-কাণ্ডে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের ফাঁসানো হচ্ছে জানিয়ে মমতা বলেছেন, মুকুল টাকা নিয়েছেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন না। নেত্রী কেন মুকুলের টাকা নেওয়ার প্রসঙ্গ এ দিনের বৈঠকে উল্লেখ করলেন, তা নিয়ে দলে নতুন করে জল্পনা শুরু হয়েছে। বৈঠকে নেত্রী স্পষ্ট জানিয়েছেন, সারদা কাণ্ডে অভিযুক্ত এবং ধৃত মন্ত্রী মদন মিত্র, সাংসদ সৃঞ্জয় বসু ‘নির্দোষ’। তাঁদের ফাঁসানো হয়েছে। এমনকী, দলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক শঙ্কুদেব পণ্ডাও নির্দোষ। তাঁদের বিরুদ্ধে

সারদা-কাণ্ডে যুক্ত থাকার কোনও প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবে না। এ নিয়ে মানুষের কাছে প্রচারের নির্দেশ দিয়েছেন দলনেত্রী। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, দল অভিযুক্ত মন্ত্রী, নেতাদের পাশেই থাকবে। সেই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, মদন ক্লাবের হয়ে টাকা তুলতে গিয়ে বোকামি করেছে। দলনেত্রীর এই বক্তব্যে তৃণমূলের অনেক নেতাই বিস্মিত। তাঁদের

প্রশ্ন, “ক্লাবকে টাকা দেওয়ার কথা বলে মমতা কার্যত সারদার টাকা নেওয়ার অভিযোগকেই মান্যতা দিলেন নাকি?”

বৈঠকে তৃণমূল নেত্রী পাল্টা অভিযোগ করেন, বেআইনি লগ্নি সংস্থার থেকে সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম ও কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান টাকা নিয়েছেন। সেলিম পাল্টা বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী যদি এই কথা বলে থাকেন, তা হলে ওঁর মেনে নেওয়া উচিত সারদা-কাণ্ডে রাজ্য প্রশাসনের গঠিত সিট-এর তদন্ত ছিল ভাঁওতা। তারা প্রায় দেড় বছর তদন্ত করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী এখন আমি বা আর যাঁদের নাম বলছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ওঁরই গড়া সিট তা হলে পদক্ষেপ করেনি কেন?” সেলিমের দাবি, “আমাদের বিরুদ্ধে কোনও তথ্য থাকলে উনি সিবিআইকে জানান। সিবিআইয়ের মুখোমুখি হতে আমরা তৈরি।” সব তথ্যপ্রমাণ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে মুখোমুখি বিতর্কে আসারও চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন সেলিম। মান্নানের প্রতিক্রিয়া, “ওঁর (মমতা) হাতে তো সরকার রয়েছে। তিনি যদি মনে করেন চিট ফান্ড বা অন্য কোনও জায়গা থেকে আমি আর্থিক বা অন্য কোনও সুযোগ নিয়েছি, তা হলে তদন্তের নির্দেশ দিন।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement