বিধি ভেঙে নির্মাণ করা যাবে না সুন্দরবনে। পাশাপাশি সেখানে ইতিমধ্যে যত অবৈধ নির্মাণ হয়েছে, সে সবও ভেঙে ফেলতে হবে বলে বুধবার নির্দেশ দিল জাতীয় পরিবেশ আদালতের (ন্যশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল) পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চ। যার জেরে মুখ্যমন্ত্রীর সাধের পর্যটন-পরিকল্পনার ভবিষ্যৎও প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল বলে প্রশাসনের একাংশ মনে করছে।
সুন্দরবন সংক্রান্ত একটি মামলায় বিচারপতি প্রতাপ রায় ও বিশেষজ্ঞ-সদস্য পি সি মিশ্রের ওই ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন বলেছে, সুন্দরবনের পরিবেশ ও ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে যথোচিত উদ্যোগী হতে হবে। এ জন্য রাজ্যের মুখ্যসচিবকে মাথায় রেখে একটি কমিটি গড়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। কমিটি আদালতকে নিয়মিত রিপোর্ট দেবে।
সম্প্রতি শিল্পপতি ও মন্ত্রী-সচিবদের নিয়ে গঙ্গাসাগরে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে তিনি ঘোষণা করেছেন, সাগরদ্বীপ-সহ সুন্দরবনের কোণে কোণে পর্যটনের বিকাশ ঘটানো হবে। কিন্তু এ দিন পরিবেশ আদালতের নির্দেশ শুনে অনেকেই মনে করছেন, মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছেপূরণের পথে বড়সড় সংশয় দেখা দিল। বস্তুত মুখ্যমন্ত্রী সুন্দরবনে যে ভাবে পর্যটন প্রসারের পরিকল্পনা করেছেন, তাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্টের সমূহ সম্ভাবনা আছে বলে আগেই মত প্রকাশ করেছিলেন পরিবেশবিদদের একাংশ। “সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হলে কলকাতারও মস্ত বিপদ।” বলছেন তাঁরা
এবং সেই আশঙ্কাই প্রকাশ করে কলকাতায় পরিবেশ আদালতের পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চে মামলা করেছিলেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। সুন্দরবনে বেআইনি নির্মাণের রমরমা, ম্যানগ্রোভ ধ্বংস, নির্বিচারে মীন ধরা ও কাটাতেলে চালিত মোটরবোটের দাপাদাপিতে সুন্দরবনের পরিবেশ কী ভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ছে, তা আদালতের গোচরে এনেছিলেন তিনি। একই সঙ্গে তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত পর্যটন প্রকল্পের প্রসঙ্গ। সুভাষবাবুর বক্তব্য: সুন্দরবনে বনাঞ্চলের বাইরেও রয়েছে সংরক্ষিত বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা, যেখানে পর্যটনের মতো শিল্প গড়ার অনুমতি নেই। “রাজ্যের পর্যটন-পরিকল্পনা রূপায়িত হলে পুরো অঞ্চলের পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।” আশঙ্কা প্রকাশ করেন সুভাষবাবু।
এ দিন পরিবেশ আদালতের নির্দেশে তাঁর আবেদন গ্রাহ্য হয়েছে বলেই মনে করছেন প্রশাসন ও পরিবেশবিদদের অনেকে। রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসুও আদালতের নির্দেশকে স্বাগত জানিয়েছেন। মন্ত্রীর কথায়, “প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রকে নষ্ট করে উন্নয়ন হয় না। আমরা পর্যটন করলে পরিবেশগত ছাড়পত্র নিয়েই করব।” পর্যটন দফতরের একাংশের পর্যবেক্ষণ, উপকূল-বিধির তোয়াক্কা না-করে যথেচ্ছ ইমারত বানালে কী হয়, মন্দারমণি তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
ওঁরা মনে করছেন, আদালত হস্তক্ষেপ না-করলে সুন্দরবনের হালও অচিরে তেমন হয়ে পড়বে।
সুন্দরবন রক্ষায় প্রশাসনের এত গাফিলতি কেন?
সরকারি সূত্রের ব্যাখ্যা: সুন্দরবনে রাজ্য সরকারের অন্তত পনেরোটি দফতর বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত। কিন্তু তাদের মধ্যে হামেশাই সমন্বয়ের অভাব। ফলে প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধের কড়াকড়ি খাতায়-কলমে থাকলেও বাস্তবে তার বালাই থাকে না। যার সুযোগ নিয়ে তামাম তল্লাটে ব্যাঙের ছাতার মতো মাথা তুলেছে অসংখ্য অবৈধ নির্মাণ।
সরকারের অন্দরের খবর: রাজ্যে সুসংহত উপকূলীয় পরিচালন ব্যবস্থা গড়ে উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নের বিবিধ প্রকল্পকে তার আওতায় আনা হয়েছে। সেখানে অর্থের বড় জোগানদার বিশ্বব্যাঙ্ক। কিন্তু গত বছর দুই যাবৎ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উপকূলরক্ষার কাজকর্মের ধরণ দেখে বিশ্বব্যাঙ্কের পর্যালোচনাতেও তার সমালোচনা হয়েছে। রাজ্য সরকারের এক পরিবেশ-বিজ্ঞানীর কটাক্ষ, “রাজনীতির ঠেলাতেই সমস্ত বিধিনিষেধ উড়ে যাচ্ছে।”
ওঁদের আশা, আদালতের এ দিনের নির্দেশ অনিয়মের বহরে লাগাম টানবে। বিধি-নিষেধ শিকেয় তুলে সুন্দরবনে যে ভাবে ম্যানগ্রোভ ও জীব-বৈচিত্র ধ্বংস করা হচ্ছে, সুভাষবাবুর আবেদনে তারও বিস্তারিত ছবি তুলে ধরা হয়েছে। “নিয়ম না-মেনে কাতারে কাতারে মীন ধরা হচ্ছে। যত্রতত্র গজিয়ে উঠছে ইটভাটা। বেআইনি বাঁধ দিয়ে ম্যানগ্রোভ নষ্ট করে চলছে মাছ চাষ।” অভিযোগ তাঁর। এমনকী, গদখালির কাছে রাজ্য সরকারি বাংলোই পরিবেশ-বিধি ভেঙে তৈরি হচ্ছে বলে তাঁর দাবি।
এ হেন প্রেক্ষাপটে এ দিন পরিবেশ আদালত রাজ্যের মুখ্যসচিবকে সুন্দরবন বাঁচাতে নজরদার কমিটি গড়তে বলেছে। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসকদেরও সক্রিয় হতে বলা হয়েছে। আদালতের নির্দেশ, এই কাজে সরকারকে এগোতে হবে সুভাষবাবুদের সাহায্য নিয়ে। মুখ্যসচিবের কমিটি কী ব্যবস্থা নিল, আগামী ছ’সপ্তাহের মধ্যে কোর্টের কাছে তা জানাতে হবে।
মামলাটির পরবর্তী শুনানি ৪ মার্চ।