রবিবারের পরে তৃণমূলের অন্দরে নয়া রসিকতা শুরু হয়েছে, ‘যে যায় যাদবপুরে, সে হয় সুমন (কবীর সুমন, যাদবপুর কেন্দ্রের প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ)’!
যাঁকে ঘিরে এই সাম্প্রতিক রসিকতা, যাদবপুরের বর্তমান তৃণমূল সাংসদ সেই সুগত বসু হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক। নেতাজি পরিবারের এই সদস্য রাজনীতিতে সে ভাবে সড়গড় নন। সাংসদ হওয়ার সাত মাস পরেও রাজনীতির ভাষা সে ভাবে আয়ত্ত করতে পারেননি। তবে ভাল ছাত্রের মতো তিনি যে দ্রুত শিখে নিচ্ছেন, তার প্রমাণ দিলেন সোমবার। দুর্নীতি-সহ একাধিক বিষয়ে মন্তব্য করে দলকে অস্বস্তিতে ফেলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তৃণমূলের ‘গাইডলাইন’ মেনে মুখ খুললেন! হিন্দুত্ব থেকে দলনেত্রীর সততা সব বিষয়ে দলের সূত্র মেনে মন্তব্য করলেন এই অধ্যাপক-সাংসদ!
এমনিতে সুগতবাবু কোনও দিনই তেমন বলিয়েকইয়ে বলে পরিচিত নন। বিতর্কিত মন্তব্য করতে, মিডিয়ায় ঘনঘন মুখ খুলতে তাঁকে বিশেষ কেউ দেখেনি। সারদার মতো বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার হাতে সাধারণ মানুষের টাকা নয়ছয় নিয়ে গতকাল সরব হয়েছিলেন এহেন সুগতই। দোষীদের শাস্তির দাবিও তুলেছিলেন তিনি। তাই শুনেই সাড়া পড়ে যায় বিভিন্ন মহলে। শুরু হয় নানা চর্চাও। তবে কি সুগতও এ বার বিদ্রোহী হচ্ছেন? শিক্ষাবিদ কি রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছেন? যাদবপুরে তাঁর পূর্বসূরি কবীর সুমনের পথ নিচ্ছেন?
আজ অবশ্য উত্তর মিলেছে। কারণ অনেকটাই সুর বদলেছেন সুগত! গত কালের মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে জানান, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের পরে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে যা বলেছিলেন, তা ‘কোনও বিশেষ মামলা বা তদন্ত বা ব্যক্তি নিয়ে নয়’। কিছুটা উপযাচক হয়ে এ দিন মমতার ‘ব্যক্তিগত সততার’ পক্ষেও সওয়াল করেছেন তিনি। এমনকী দলের নীতি মেনে বিজেপিকেও বিঁধে বলেছেন, “শুনলাম বিজেপি-র সভাপতি আমায় অভিনন্দন জানিয়েছেন! তাঁর উৎফুল্ল হওয়ার কোনও কারণ নেই। আরএসএস, বিজেপি বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন চালিয়ে যাব। দেশের সবচেয়ে বড় বিপদ এখন হিন্দুত্ববাদ।”
এই স্বতঃপ্রণোদিত ব্যাখ্যার পরেও একটা অস্বস্তির কাঁটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে সংসদীয় দলের অন্দরে। কারণ, রাজ্যের মন্ত্রী সারদা মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পরে তৃণমূলের সাংসদরা যখন সংসদের বাইরে নানা ভাবে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, তখন সেই আসরে গরহাজির ছিলেন সুগত। তার পরে তাঁর গত কালের মন্তব্য নিয়ে বিরোধীরা ঝড় তোলায় তৃণমূলের অস্বস্তি বেড়েছে বহু গুণ। সারদা-কাণ্ডে প্রবল চাপে থাকা দলের অনেক সাংসদই তাই সুগতর আজকের ব্যাখ্যার পরেও সন্তুষ্ট নন। তাঁদের বক্তব্য, গত কালের ওই সব মন্তব্য ‘কাণ্ডজ্ঞানহীনতার’ প্রমাণ! সারদা নিয়ে এই তোলপাড়ের আবহে বেফাঁস কথা বলার কোনও ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ হয় না। রাজনীতিতে নবাগত হলেও এটুকু বোঝা উচিত ছিল সুগতবাবুর।
কেউ কেউ অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সুগত কারও নাম করে কিছু বলেননি। ফলে তাঁকে ততটাও দোষারোপ করা ঠিক নয়। অনেকেরই ব্যাখ্যা, সুগতবাবু আদতে মাস্টারমশাই রয়ে গিয়েছেন, রাজনীতিবিদ হননি! কেউ আবার নতুন করে বিতর্কের ভয়ে মন্তব্যই করতে চাননি!
সব মিলিয়ে এক সুগত নিয়ে বহু মত!
তৃণমূলে মমতার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত বারাসতের সাংসদ কাকলি যেমন কোনও রাখঢাক না করেই বলেছেন, “যে দলের টিকিটে জয় এসেছে, সেই দলের বিরুদ্ধে বাইরে এ ভাবে কথা বলা একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না।” সাংসদ শতাব্দী রায় আবার মনে করেন, “এখন গোটা বিষয়টি এমন জট পাকানো জায়গায় পৌঁছেছে যে এই ধরনের কথা বললে বিতর্ক বাড়বে বই কমবে না। এমন ধরনের মন্তব্যে কোনও সমস্যারই সমাধান হবে না।”
তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় আবার এতটা কড়া নন। তিনি মনে করেন, সুগতবাবু যা বলেছেন তা সার্বিক ভাবে তাঁর নিজস্ব নীতির প্রশ্ন। তিনি কোনও দল বা নামের উল্লেখ করেননি। সৌগতর কথায়, “উনি তো দলের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। কিছু নীতির কথা বিবৃত করেছেন মাত্র। লক্ষ্মণরেখা ছাড়াননি।” কিছুটা একই সুর উলুবেড়িয়ার সাংসদ সুলতান আহমেদের। তাঁর বক্তব্য, “উনি যা বলেছেন, সাধারণ ভাবে বলেছেন। কোনও বিশেষ দল বা ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে নয়।”
বিষয়টি নিয়ে আদৌ মুখ খুলছেন না, বরং আঁতকে উঠছেন, এমন সাংসদের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়! তৃণমূলের প্রথম বারের সাংসদ সৌমিত্র খান যেমন গা বাঁচানোর ঢংয়ে বললেন, “আমরা একেবারেই চুনোপুঁটি। এত বড় ব্যাপারে কথা বলার অধিকারীই নই!” প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রশ্ন শুনে দ্রুত ‘নো কমেন্টস। একটাও কথা নয় এ ব্যাপারে’ বলেই চুপ করে গেলেন! শিশির অধিকারী এবং মুকুল রায়ের মতো নেতারাও এ নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ।
এই দুই দলের বাইরেও একটা বৃত্ত রয়েছে। যাঁরা ইতিহাসের অধ্যাপক সুগত বসুকে অন্য চোখে দেখেন। দলের অভিনেত্রী-সাংসদ মুনমুন সেন যেমন বললেন, “অধ্যাপক বসু সংসদে যে ভূমিকায় থাকেন, তাতে মনে হয় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন। এটি তাঁর এবং আমাদের জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আবার এ-ও মেনে নিতে হবে যে, তিনি আগে এক জন মাস্টারমশাই, পরে রাজনীতিবিদ।”
নেতাজি ও স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতার ছবিও রাজ্যের উৎসবে রাখতে হবে বলে যুবকল্যাণ দফতর যে নির্দেশিকা জারি করেছে, গত কাল সেটি নিয়ে সরব হন সুগত। জানিয়েছিলেন, নেতাজি বা বিবেকানন্দের মতো মনীষীরা অন্য স্তরের মানুষ। আজ সমালোচনার সুর বদলে বলেন, “নেতাজি বা বিবেকানন্দের মতো মনীষীদের আজকের নেতারা পূজনীয় বলে মনে করেন। তাঁরা অনুপ্রেরণা নেন এই সব বড় মাপের মানুষের থেকে।”
সব শেষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সততা প্রসঙ্গ। গত কাল এ নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি। আজ কিন্তু সংসদের লাইব্রেরিতে বসে নিজে থেকেই টেনে আনেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সততার প্রসঙ্গ। বলেন, “মমতার ব্যক্তিগত সততার উপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। এই সততা তাঁর গোটা জীবনের অর্জন।”
বললেন তো, কিন্তু অস্বস্তির খোঁচা যাচ্ছে কি?