স্বাগত। খাপরাইলের সভায় নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বিমল গুরুঙ্গ। বৃহস্পতিবার বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
বাংলার মানুষের “দু’হাতে লাড্ডু” পাওয়ার উপায় বাতলে রাজ্য রাজনীতিতে এক নতুন রসায়নের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। দু’ মাসের মাথায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী দুর্নীতির নানা প্রসঙ্গ তুলে বিঁধলেন রাজ্য সরকারকে। এমনকী টেনে আনলেন অস্বস্তিকর সারদা-প্রসঙ্গও। বৃহস্পতিবার উত্তরবঙ্গের জনসভায় বললেন, রাজ্যের মানুষকে যাতে কেউ ধোঁকা দিতে না পারে, তার জন্য দিল্লিতে ‘মাস্টারজি’ দরকার।
শিলিগুড়ির ১০ কিলোমিটার দূরে খাপরাইলের জনসভায় এ দিন মোদী ছিলেন রীতিমতো আক্রমণাত্মক। প্রশাসনিক ব্যর্থতা থেকে রাজনৈতিক অসৌজন্য, সব বিষয়েই তিনি তৃণমূল নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া সমালোচনা করলেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, মোদীর ব্রিগেডের সফরের পর থেকে এ যাবৎ মমতা যে ভাবে তাঁর টানা সমালোচনা করছেন, এ দিন তারই প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতায়।
তৃণমূলের প্রতি তাঁর আপসহীন মনোভাবের ইঙ্গিত দিয়ে মোদী এ দিন বেসরকারি অর্থলগ্নিকারী সংস্থা ‘সারদা’-র নাম করে বলেন, “সারদা-কাণ্ডে জড়িতদের সকলের সাজা হওয়া দরকার। যে রাজনৈতিক দলের লোকই তাতে জড়িত থাকুন না কেন তা বরদাস্ত করা হবে না। সারদা-কাণ্ডে জড়িতদের কড়া সাজা দিতেই বিজেপিকে কেন্দ্রে আনতে হবে।”
শিলিগুড়ির সভা বলেই হয়তো শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (এসজেডিএ) দুর্নীতি মামলার কথা টেনেছেন মোদী। তিনি বলেন, “শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়িতে যে উন্নয়নের টাকা নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে তা শুনছি। সেটা খুব বড় মাপের টাকা হয়তো নয়। কিন্তু, তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে এত কম সময়ের মধ্যে এ ধরনের লুঠ হয়েছে। তা হলে বেশি সময় পেলে এঁরা কী করবে? এতে শাসক দল ও সরকারের আদত বোঝা যায়।” এর পরেই কিছুটা থেমে তিনি নিজস্ব ভঙ্গিমায় বলেন, “উন্নয়নের নামে মানুষের সঙ্গে ধোঁকা দেওয়া যাবে না। দুর্নীতি করা চলবে না। কোনও রাজ্যে যাতে এ সব না হয়, সে জন্যই দিল্লিতে একজন ‘বড় মাস্টারজি’ দরকার। যিনি জবরদস্ত ভাবে কাজ করবেন। সকলে ঠান্ডা থাকবে।”
গত ৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ব্রিগেডের সভায় মোদী তৃণমূল সরকারের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো আছেনই, আগামী দিনে দিল্লিতে বিজেপি সরকার গড়ার সুযোগ দিলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের “দুই হাতেই লাড্ডু” মিলবে। মোদী দাবি করেছিলেন, কেন্দ্রে বিজেপি-কে ক্ষমতায় আনলে তিনি, মমতা এবং রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় মিলে সোনার বাংলা গড়বেন। পরিবর্তন চেয়েই যে মমতাকে বাংলার মানুষ ক্ষমতায় এনেছেন, সে কথাও বলেছিলেন তিনি। এ দিনের জনসভায় মোদী দাবি করেন, বাংলায় যা এসেছে তা “নকল পরিবর্তন।” সরকার বদলের পরেও পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নে গতি আসেনি। বামফ্রন্টের মতোই কাজ করছে তৃণমূল।
“এটা জনতাকে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে,” বলেন তিনি।
এতদিন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে ‘ছোট দল’ হিসেবে দেখলেও তৃণমূল ইদানীং যে নিয়ম করে প্রতি সভায় বিজেপিকে আক্রমণ করছে সেই প্রসঙ্গেও মমতাকে নাম না-করে কটাক্ষ করেছেন নরেন্দ্র মোদী। তাঁর কথায়, “আমি ভেবেছিলাম এখানকার মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস, সিপিএমের বিরুদ্ধে বলবেন। কিন্তু, এখন তো দেখছি, এখানকার মুখ্যমন্ত্রীর দিনে একশোবার আমার নাম না-করলে ভাত হজম হয় না!” তাঁর দাবি, কথায়-কথায় বিজেপিকে তুলোধোনা করাটা একেবারেই ‘রাজনৈতিক খেলা’।
মমতার এমন কড়া সমালোচনা করায় নরেন্দ্র মোদীকে পাল্টা আক্রমণ করল তৃণমূল। এ দিন তৃণমূল ভবনে দলীয় মুখপাত্র ও সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন বলেন, “মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছেন, ১৬ মে তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে। ওঁর হাতে ২০০২ সালের দাঙ্গার রক্ত। এমন লোককে দেশের মানুষ প্রধানমন্ত্রী হতে দেবে না।”
বস্তুত ব্রিগেডে মোদী দু’হাতে লাড্ডুর উপায় বাতলালেও, পশ্চিমবঙ্গে ভোটের প্রচারের গোড়া থেকেই তৃণমূল নেত্রী লাগাতার সমালোচনা করেন বিজেপির। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী এত দিন কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাননি। সেই কারণে শিলিগুড়ির সভায় তিনি কী জবাব দেন তা নিয়ে বিজেপির অন্দরেও কৌতূহল ছিল। বিজেপির দার্জিলিং জেলা সভাপতি রথীন্দ্র বসু বলেন, “যে ভাবে ‘সাম্প্রদায়িক’ বলে তৃণমূল নেত্রী টানা অভিযোগ করছিলেন, তার জবাব দেওয়া ভীষণ জরুরি ছিল। বিশেষত দার্জিলিঙের জন্য।”
সম্ভবত সেই খবর আগেই পৌঁছেছে মোদীর কাছেও। বেলা ১০টা নাগাদ বাগডোগরায় পৌঁছে সেখান থেকে হেলিকপ্টারে খাপরাইলের সভা মঞ্চে তিনি যখন পৌঁছন, ততক্ষণে উপচে পড়ছে ভিড়। শুরু হয়েছে তুমুল হর্ষধ্বনি। মোর্চা নেতা-কর্মী, কেপিপির নেতা-সমর্থক, আদিবাসীদের একটি সংগঠনের (পিপিপি) নেতা-কর্মীরা ও বিজেপির লোকজনের ভিড়ে মাঠে তিলধারণের জায়গা নেই। কেউ শাঁখে ফু দিচ্ছেন। কেউ উলুধ্বনি করছেন। তার মধ্যেই বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ কোনও মতে মিনিট তিনেক বক্তৃতা দেওয়ার পরে বলতে ওঠেন বিজেপির প্রধান বক্তা। তাঁর পৌনে এক ঘণ্টার বক্তৃতায় ঘুরেফিরেই নাম না-করে ‘এখানকার মুখ্যমন্ত্রী’ বলে যতবার, যত প্রসঙ্গে তৃণমূল নেত্রীর সমালোচনা করেছেন মোদী, ততবারই ভিড়ে ঠাসা সভা হইহই করে উঠেছে।
আর লাড্ডু নয়, মোদী এ বার দিয়ে গেলেন কড়া দাওয়াইয়ের বার্তা।