রক্তক্ষরণের দাওয়াই কী, খোঁজ সম্মেলনে

রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পরে তিন বছর আগে ছিল প্রথম সম্মেলন। সেই সম্মেলনের প্রতিবেদনেই সিপিএম স্পষ্ট করে দিয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মোকাবিলায় বিরোধী নেত্রী মমতার মতো বন্ধ-অবরোধ-ভাঙচুরের রাস্তায় যাবে না তারা। মাঝের তিন বছরে রাজ্য রাজনীতিতে বহু জল গড়িয়েছে।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী ও শুভাশিস ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৫ ০৩:১৬
Share:

রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পরে তিন বছর আগে ছিল প্রথম সম্মেলন। সেই সম্মেলনের প্রতিবেদনেই সিপিএম স্পষ্ট করে দিয়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মোকাবিলায় বিরোধী নেত্রী মমতার মতো বন্ধ-অবরোধ-ভাঙচুরের রাস্তায় যাবে না তারা। মাঝের তিন বছরে রাজ্য রাজনীতিতে বহু জল গড়িয়েছে। সারদা কেলেঙ্কারি-সহ নানা ঘটনায় উপুর্যপরি বিড়ম্বনায় পড়েছে শাসক দল তৃণমূল। কিন্তু সিপিএমের অবস্থার উন্নতি দূরে থাক, ভোটে ধারাবাহিক ভাবে রক্তক্ষরণ হয়েই চলেছে! সিপিএমের ভোট ভাঙিয়ে বরং বিরোধী শক্তি হিসাবে উঠে এসেছে বিজেপি। তিন বছর পরে আরও একটি সম্মেলনের মুখে সিপিএমের অন্দরে এখন তাই একটাই প্রশ্ন। রক্তপাত বন্ধের দাওয়াই কী?

Advertisement

দলের ভিতরে-বাইরে অনেকে বলতে শুরু করেছেন, বিরোধী শক্তি হিসাবে আন্দোলনহীনতাই আসলে সিপিএমকে পিছিয়ে দিচ্ছে। সোশ্যাল সাইটেও বহু বামমনস্ক মানুষ মতামত দিচ্ছেন, বিরোধী হতে গেলে আক্রমণাত্মক হওয়াই ভাল। রাস্তায় নেমে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করতে না পারলে বিরোধীদের বিশেষ ‘স্বীকৃতি’ দেন না মানুষ। বিধানসভার ভিতরে বামেরা যা-ই করুক, সভা-সমাবেশে যতই ভিড় হোক, ভোটবাক্সে আম জনতার তেমন একটা সমর্থন মেলার সম্ভাবনা তাতে কম। ব্রিগেড সমাবেশ থেকে রবিবার পর্দা উঠতে চলেছে সিপিএমের ২৪ তম রাজ্য সম্মেলন-পর্বের। পর দিন সোমবার থেকে চার দিন চলবে আলোচনা। সেখানে এ বার বিতর্ক দলের সামনের চলার পথ নিয়েই। দলেরই একাংশ বলছে, মমতার সরকার ক্ষমতায় আসার পরে চার বছরে বামেরা ‘সুশীল’ বিরোধী হয়ে থেকেছে। কিন্তু তাতে নির্বাচনে কোনও লাভই হয়নি! তা হলে সামনের বিধানসভা ভোটের আগে বাকি এক বছরে একটু ‘জঙ্গি’ হলে ক্ষতি কী?

সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্য বলছেন, রাস্তা বদলে রাতারাতি একেবারে উল্টো দিকে হাঁটার সম্ভাবনা কম। তবে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ানো ছাড়া প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখাই যে কঠিন, তা তাঁরা বুঝতে পারছেন। দলের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, “বিরোধী মমতা যেমন করতেন, আমরাও ঠিক তেমন করব, হঠাৎ নবান্ন দখল করতে চলে যাব বা বাস ভাঙব বা বিধানসভার লবিতে ভাঙচুর করব এটা ভাবার মতো বিষয়ই নয়! কী করা উচিত, তা নিয়ে জেলা সম্মেলনগুলিতেও বেশ খানিকটা আলোচনা হয়েছে। আমাদের যেটা করতে হবে, সেটা হল স্থানীয় ও আদায়যোগ্য দাবি নিয়ে একেবারে নিচু তলা থেকে জোরদার আন্দোলন।”

Advertisement

রাজ্য সিপিএমের ওই শীর্ষ নেতা যে কথা বলছেন, তার প্রতিফলন রয়েছে এ বারের রাজ্য সম্মেলনে পেশ করার জন্য তৈরি-হওয়া খসড়া রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রতিবেদনেও। সেখানে যেমন স্থানীয় দাবিতে তীব্র আন্দোলন এবং ‘সক্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাসম্পন্ন পার্টি’ গড়ে তোলার ডাক দেওয়া হয়েছে, তেমনই মেনে নেওয়া হয়েছে: ‘কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয় সরকারের নীতিগুলির কারণে শ্রমিক কৃষক-সহ সাধারণ ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ বিপন্ন হলেও আমাদের সমর্থন ক্ষয়ের ধারা অব্যাহত আছে। আমাদের পার্টি ও বামফ্রন্টের প্রতি তাঁদের আস্থা পুনঃস্থাপনের পর্যায়ে নিয়ে আসার লক্ষ্যে জন ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী নীতি ও প্রয়োগ ধারার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক প্রচার আন্দোলন করতে হবে। তাড়াহুড়ো না করে সময় নিয়ে বাড়ি ও পরিবারভিত্তিক প্রচারেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে মানুষের চিন্তার গতিপ্রকৃতি বোঝা যাবে না’।

মানুষের চিন্তার এই গতিপ্রকৃতি বোঝার লক্ষ্যেই কিছু পরামর্শ আসতে শুরু করেছে দলের ভিতর থেকেই। রাজ্য কমিটির বর্ষীয়ান সদস্য কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় যেমন মনে করছেন, সাতের দশকের সনাতনী বামপন্থী প্রথা ফিরিয়ে না আনলে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা অসম্ভব। কান্তিবাবুর কথায়, “ওই সময় এলাকায় এলাকায় কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে দলীয় নেতারা গিয়ে থাকতেন। এলাকার সব সমস্যায় মানুষের পাশে থেকে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলতেন। মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়েছিল। বামপন্থী নেতাদের তখন সাধারণ মানুষ নিজের পরম আত্মীয় মনে করতেন।” সেই জন্যই ওই সময়ে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে লড়াই করেও বামফ্রন্ট বিপুল জনসমর্থন পেয়েছিল বলে তাঁর মত। এমনকী, এখনকার প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজে হাতে-কলমে এই কাজ করেই মানুষের সাড়া পাচ্ছেন কান্তিবাবু নিজে। বিদায়ী রাজ্য কমিটির একাধিক নেতাই মনে করছেন, নির্দেশিকা জারি বা পরামর্শ দেওয়ার কাজে নিজেদের আবদ্ধ না রেখে নেতৃত্বকে কর্মীদের পাশাপাশিই সাধারণ মানুষের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলায় নজর দিতে হবে।

বনগাঁ ও কৃষ্ণগঞ্জের সাম্প্রতিক উপনির্বাচনের ফলাফল দেখিয়ে রাজ্য সম্মেলনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ থেকে দু’টি জিনিস স্পষ্ট। প্রথমত, তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে ভোট মেরুকরণের প্রবণতা বাড়ছে। এবং দ্বিতীয়ত, সরকার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে নানা ক্ষোভ থাকলেও তাকে কাজে লাগানোর মতো সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে সিপিএমের ব্যর্থতা থেকেই যাচ্ছে। এর সঙ্গেই দলের রাজ্য নেতাদের কেউ কেউ যোগ করছেন, ৩৪ বছরের বাম শাসন কালে গ্রামের গরিব মানুষের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। শিক্ষা, ব্যবসা ও চাকরির মাধ্যমে আর্থিক উন্নয়ন ঘটেছে। এই পরিবর্তিত অংশ বামেরা ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পরে আর প্রতিবাদী আন্দোলনে বিশেষ সামিল হতে চাইছে না। তাই বামেদের কাজটা আরও কঠিন।

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলছেন, “উপনির্বাচনে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দিক থেকে বেশ কিছু সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলে গিয়েছে। আবার আর এক অংশ গিয়েছে বিজেপি-তে। কেন্দ্র ও রাজ্য, দু’টি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বামেরাই আসল সৈনিক, এই বিশ্বাসটা মানুষের মধ্যে জাগানোই জরুরি।” সম্মেলনের খসড়া রিপোর্টেও বলা হয়েছে, ‘আজকের দিনে কঠিন অথচ সম্ভাবনাময় দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিকে গণতান্ত্রিক শক্তির অনুকূলে কাজে লাগাতে গেলে প্রয়োজন আক্রান্ত শ্রমজীবী, কৃষক ও সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো’।

এ বারের সম্মেলনেই নতুন রাজ্য সম্পাদক পাওয়ার কথা সিপিএমের। কিন্তু মানুষের ‘পাশে দাঁড়ানো’র সাংগঠনিক কাজে ঘাটতি থাকলে মুখ বদলেও যে রাতারাতি হাওয়া ঘুরবে না, সম্মেলন শুরুর আগেই টের পাচ্ছেন সিপিএম নেতৃত্ব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement