উত্তরবঙ্গ দিয়ে রাজ্যে পাঁচ দফার লোকসভা ভোট শুরু হচ্ছে আজ, বৃহস্পতিবার। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ আজ। প্রতি কেন্দ্রেই এ বার চতুর্মুখী বা বহুমুখী লড়াই।
প্রথম দফার ভোট শুরুর আগেই অবশ্য রাজ্যের শাসক দলের যুব শাখার কার্যকরী সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী ‘কী ভাবে ভোট করাতে হয়, তা আমরা জানি’ বলে মন্তব্য করায় বিতর্ক বেধেছে। বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, শাসক দল যে ভয় দেখিয়ে ও গায়ের জোরে ভোটে জিততে চাইছে, তার প্রমাণ সৌরভের এই বক্তব্য। তারই পাশাপাশি, রাজ্যে পাঁচ দফার ভোটেই বেশ কিছু এলাকায় বেনিয়ম এবং গোলমালের আশঙ্কা আছে বলে রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা রিপোর্টে সম্প্রতি সতর্ক করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু এলাকাও আছে, যেখানে প্রথম পর্বে ভোট হবে। বিরোধী বামেরা বুধবারই নির্বাচন কমিশনে গিয়ে কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলায় সুষ্ঠু ও অবাধ ভোটের জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। আরএসপি নেতৃত্বের তো নির্দিষ্ট দাবি, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত ‘সিল’ করে দেওয়া হোক।
বীরপাড়ায় মঙ্গলবার রাতে এক দলীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সৌরভ বলেন, “ভোটে কেউ জেতে না। কৌশলে জিততে হয়! কী করে ভোট করতে হয়, তা আমরা জানি!” এর পরেই তিনি দাবি করেন, এ বার জলপাইগুড়ি জেলার দু’টি আসনে দলীয় প্রার্থীকেই সেই কৌশলে জেতাবেন তাঁরা। সব ভোট তাঁদের বাক্সেই পড়বে বলে সৌরভের ইঙ্গিতে নির্বাচনী প্রক্রিয়া সুষ্ঠু না-হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে বিরোধীরা সরব হয়েছে। সৌরভের মন্তব্য টিভি চ্যানেলে সম্প্রচারিত হতেই এ দিন কলকাতায় মুখ্য নির্বাচন আধিকারিক সুনীল গুপ্তের কাছে বামেরা লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অশোক ঘোষ বলেছেন, “তৃণমূল সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট করতে দেবে না। ভয় দেখাচ্ছে। সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন যাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তা বলা হয়েছে।” বামেরা জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারের সমস্ত স্পর্শকাতর বুথে সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগের দাবিও জানিয়েছে কমিশনে।
সৌরভের অবশ্য দাবি, তাঁর বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে। তিনি বলেন, “আমি বলেছি, ভোটে কেউ জেতে না। বাড়িতে বসে থেকে বলে দিলাম, অমুক চিহ্নে ভোট দিন তাতে হয় না! কৌশল নিতে হয়। বামফ্রন্ট এত দিন যে কৌশলে ভোট করেছে, সেটা আমরা ধরে ফেলেছি। আমার কথার মধ্যে কোথায় উস্কানি রয়েছে?” যদিও জেলা বাম নেতৃত্ব সৌরভের ওই ব্যাখ্যা মানতে নারাজ। তাঁদের পাল্টা দাবি, তিনি যা বলেছেন, সেটাই তো বৈদ্যুতিন মাধ্যমে দেখানো হচ্ছে! সিপিএমের জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “উনি যা বলেছেন, সেটা গণতন্ত্র বিরোধী ও ধ্বংসাত্মক। মানুষ ভোট দিয়ে প্রার্থীকে নির্বাচিত করেন, উনি সেটা মানছেন না! আমরা কমিশনের কাছে ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানিয়েছি।”
কংগ্রেস ও বিজেপি-ও সৌরভের বক্তব্যের বিরুদ্ধে সরব। জলপাইগুড়ি জেলা কংগ্রেস সভাপতি নির্মল ঘোষ দস্তিদার বলেন, “ভোটে জিততে কৌশল কেন প্রয়োজন হবে? প্রত্যেকে কর্মসূচি সামনে রেখে আবেদন জানাবেন। তার উপরে ভিত্তি করে ভোট পাবেন। ওঁরা আসলে গায়ের জোরের কথা বলছেন!” জেলা বিজেপি সভাপতি দীপেন প্রামাণিকেরও অভিযোগ, “সৌরভবাবুরা যে সন্ত্রাসের পথে হাঁটবেন, সেটা মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন! এখন ঢোঁক গিলতে চাইছেন!”
দলের তরফে আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি লোকসভা নির্বাচনের দায়িত্বে রয়েছেন সৌরভ। তৃণমূলের অন্দরের খবর, সেই সুবাদে মঙ্গলবার বীরপাড়ায় সভা করতে গিয়ে তিনি অভিযোগ করেন, আগে বামেরা ভোটের আগে রাতের অন্ধকারে ভোটারদের চাল ও টাকা বিলি করত। তাঁর মন্তব্য, “আমরা সেই সব কৌশল জেনে ফেলেছি! এ বার একতরফা ভাবে বামেদের ভোট তুলতে দেব না!” এ সব আটকাতে তাঁদের কর্মীরা রাত জেগে এলাকায় পাহারা দেবেন বলেও তিনি জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, এত দিন বাম দুর্গ বলে পরিচিত ছিল জলপাইগুড়ি জেলা। কিন্তু বহু বাম কর্মীই এখন তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের সাহায্যেই বামেদের ওই কৌশল রুখবেন বলে দাবি করেন সৌরভ।
এই বিতর্ক শুরুর আগেই অবশ্য সতর্কতা নেওয়ার কথা উঠে এসেছে গোয়েন্দা রিপোর্টে। বীরভূমে সম্প্রতি একটি সভায় রাজ্যের এক প্রথম সারির মন্ত্রীর কিছু মন্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে গোয়েন্দা রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, লোকসভা ভোটে শাসক দলের লোকজন ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং বুথ দখলের চেষ্টা করতে পারে। গ্রাম এবং মফস্সলের অনেক জায়গায় ভোটারেরা দল বেঁধে বুথের দিকে যান। সেই সময়ে তাঁদের ভয় দেখানোর চেষ্টা হতে পারে। বিশেষত, ভোটের আগে অস্ত্র উদ্ধারের কাজ যে হেতু তেমন এগোয়নি, তাই দুষ্কৃতীদের হাতে অস্ত্র থেকে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বিরোধী দলের প্রভাব আছে, এমন এলাকায় মোটরবাইক-বাহিনী ভোটের আগেই ভয় দেখানোর চেষ্টা করতে পারে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় সশস্ত্র বাহিনীর টহল এবং অস্ত্র উদ্ধারে জোর দেওয়ার সুপারিশ করেছেন গোয়েন্দারা।
রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের (সিইও) দফতরে গিয়ে সিপিএমের রবীন দেব, ফরওয়ার্ড ব্লকের দেবব্রত রায় প্রমুখ এ দিন অভিযোগ করেছেন, কোচবিহারের কিছু এলাকায় ভোটারদের ভয় দেখানো হচ্ছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীকেও ঠিকমতো ব্যবহার করা হচ্ছে না। সিইও-র দফতর থেকেই তাঁদের কথা বলিয়ে দেওয়া হয় কোচবিহারের পুলিশ পর্যবেক্ষক জিতেন্দ্রের সঙ্গে। পরে কোচবিহারের ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহও পুলিশ পর্যবেক্ষকের সঙ্গে দেখা করে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে উপযুক্ত ভাবে ব্যবহারের দাবি জানিয়েছেন। পর্যবেক্ষক আশ্বাস দিয়েছেন, সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করতে কমিশন সক্রিয় থাকবে।