রাজ্য ছেড়ে যাবেন না, আর্জি মুখ্যমন্ত্রীর

মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘মন খারাপ করবেন না। কেউ যাবেন না।’ এমনিতে আপাত নিরীহ আবেদন। বিরোধীদের অবশ্য কটাক্ষ, সোমবার পুরুলিয়ার হুড়ায় প্রশাসনিক জনসভার মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর এই আর্জিই এ রাজ্যের শিল্পের হাঁড়ির হাল জানান দিচ্ছে! সাধারণ ভাবে পশ্চিমবঙ্গে যে কেউ ব্যবসা করতে চান না, প্রায় অর্ধশতক ধরে এটাই বাস্তব অভিজ্ঞতা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৪:৪১
Share:

বালা পরো তো দেখি। সোমবার পুরুলিয়ার জনসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রয়েছেন মুনমুন সেনও। ছবি: সুজিত মাহাতো

মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘মন খারাপ করবেন না। কেউ যাবেন না।’

Advertisement

এমনিতে আপাত নিরীহ আবেদন। বিরোধীদের অবশ্য কটাক্ষ, সোমবার পুরুলিয়ার হুড়ায় প্রশাসনিক জনসভার মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর এই আর্জিই এ রাজ্যের শিল্পের হাঁড়ির হাল জানান দিচ্ছে! সাধারণ ভাবে পশ্চিমবঙ্গে যে কেউ ব্যবসা করতে চান না, প্রায় অর্ধশতক ধরে এটাই বাস্তব অভিজ্ঞতা। এ রাজ্য থেকে শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীরা ভাল কাজের খোঁজে এবং অল্পশিক্ষিতেরাও শ্রমিকের কাজ পেতে ফি বছর মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাত, কর্নাটক-সহ ভিন্ রাজ্যে চলে যানএটাও বাস্তব। বিরোধীদের আরও অভিযোগ, ২০১১ সালে রাজ্যে বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরেও পশ্চিমবঙ্গকে লগ্নিকারীদের আদর্শ গন্তব্য হিসাবে গড়ে তুলতে পারেনি তৃণমূল সরকার। ফলে, রাজ্য থেকে শিক্ষিত মেধার বাইরে পাড়ি দেওয়াতেও রাশ টানা যায়নি।

এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এ দিন হুড়ার লধুড়কা ময়দানে প্রশাসনিক জনসভায় এ রাজ্যের লক্ষ লক্ষ বেকার তরুণ-তরুণীর কাছে মমতা ওই আর্জি রেখেছেন বলে বিরোধীদের একাংশ মনে করছেন। আবার অন্য অংশের মতে, এই আবেদন শিল্পপতিদের উদ্দেশেও বটে। শিল্পের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অশান্তি, সিন্ডিকেটের জুলুম, জমিনীতিসব মিলিয়ে এ রাজ্যে চট করে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী নয় কোনও শিল্পসংস্থা। তাদের প্রতিও এ দিন মমতা বার্তা দিতে চেয়েছেন। এ দিন পুরুলিয়া জেলার শিল্প নিয়ে বলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তুলেছেন রঘুনাথপুরের প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, “রঘুনাথপুরে শিল্প হচ্ছে। এক লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে রঘুনাথপুর, দুর্গাপুর, বড়জোড়া ও পাঁচামিতে।” এর পরেই তিনি বলেন, “মন খারাপ করবেন না। কেউ (রাজ্য ছেড়ে) যাবেন না।”

Advertisement

মমতা যতবারই পুরুলিয়া সফরে যান, ততবারই রঘুনাথপুরের শিল্প-সম্ভাবনা নিয়ে আশার কথা শোনান। বাস্তব অবশ্য বলছে অন্য কথা। এ রাজ্যে শিল্পের অন্যতম মুখ রঘুনাথপুরে শিল্পোন্নয়ন নিগমের অধিগৃহীত জমির অনেকটাই ফাঁকা পড়ে আছে! জমি জটের জেরে জয় বালাজি এখানে ইস্পাত প্রকল্প গড়েনি। শ্যাম স্টিলও পাততাড়ি গুটিয়েছে। স্পঞ্জ আয়রন কারখানার জন্য নেওয়া প্রায় ১০০ একর জমিতে কারখানা না গড়ে তার একাংশে এখন আলু-পেঁয়াজ চাষ করছে একটি শিল্প সংস্থা! রঘুনাথপুরে এখন শিল্পের হাতের পাঁচ বলতে ডিভিসি-র নির্মীয়মাণ তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প। সেই প্রকল্পও জমি-জটে পড়ে বারবার হোঁচট খেয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। রেল করিডর ও ওয়াটার করিডরের কাজে বাধা দিচ্ছেন জমিহারাদের একাংশ। তাঁদের পিছনে শাসকদলের মদত রয়েছে বলেও অভিযোগ। ইউপিএ সরকারের রেলমন্ত্রীর থাকার সময় রঘুনাথপুর লাগোয়া আদ্রায় এনটিপিসি-র সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে যে তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের ঘোষণা করেছিলেন মমতা, তা-ও বিশ বাঁও জলে।

জেলায় জেলায় যে তথ্যপ্রযুক্তি হাবের কথা মমতা ঘোষণা করেছেন, তার কাজও ধীর গতিতে চলছে। ইনফোসিসের মতো এ দেশের প্রথম সারির তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার বিনিয়োগও দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে রয়েছে বিশেষ আর্থিক অঞ্চল নিয়ে তৃণমূল সরকারের নীতির কারণে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যকে লগ্নির নয়া গন্তব্য হিসেবে তুলে ধরতে জানুয়ারির গোড়ায় ‘গ্লোবাল বেঙ্গল ইনভেস্টমেন্ট সামিট’-এর আসর বসিয়েছিল রাজ্য সরকার। শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র দাবি করে এসেছেন, এই সম্মেলন থেকে অন্তত ২ লক্ষ ৪৩ হাজার কোটি টাকার লগ্নি প্রস্তাবের মউ চুক্তি সই হয়েছে। যদিও রাজ্য প্রশাসনের কিছু আধিকারিকই আড়ালে বলছেন, এটা মুখের কথা। প্রচুর ঢাকঢোল পিটিয়ে শিল্প-সামিটের আয়োজন করলেও তা থেকে বিরাট কিছু লগ্নি-প্রতিশ্রুতি জোটেনি পশ্চিমবঙ্গের কপালে।

সব মিলিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করেই এ দিন মমতা ‘বাইরে না যাওয়ার’ আবেদন রেখেছেন বলে মনে করছে শিল্পমহলের একাংশও। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “বিনিয়োগকারীরা অন্য রাজ্যে পুঁজি নিয়ে যাচ্ছেন। ফলে এ রাজ্যের শিল্পায়নের ঢক্কানিনাদের ফানুস ফেঁসে গিয়েছে! তাই হয়তো বাস্তব বুঝে এ মন্তব্য ওঁর হতাশারই বহিঃপ্রকাশ!” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র বলেন, “পুরুলিয়াতে শিল্প-উদ্যোগের যে চেষ্টা শুরু হয়েছিল, এই সরকারের জমানায় তার প্রায় সবই একে একে বন্ধ। এখানকার মানুষ কাজের অভাবে নিয়মিত অন্য জেলা এবং অন্য রাজ্যে যাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী ওই মন্তব্য করার সময় পুরুলিয়ার এই ছবি মাথায় রেখেছিলেন কি না, জানি না! তবে আজ উপনির্বাচনে জয়ের আনন্দে আত্মহারা আছেন। তাই সত্যি কথা বলে ফেলতে পারেন!” প্রদেশ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, “এতদিন পর নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন যে রাজ্যে শিল্প আসেনি। তাই এ রকম আবেদন করেছেন।”

এক শিল্পকর্তার অবশ্য বক্তব্য, “শুধু আবেদন করে কিছু হবে না। রাজ্য সরকারকে নিজেদের শিল্প ও জমিনীতিতে বদল আনতে হবে।” তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, “জমি নিতে দেব না, অথচও বিনিয়োগও চাইবএ হয় নাকি? বিনিয়োগ না এলে কারখানাও হবে না। কারখানা না এলে কর্মসংস্থান বাড়বে না। আর তা নাহলে কাজের খোঁজে এ রাজ্যের যুবক-যুবতীদের বাইরে চলে যাওয়াও তাই ঠেকানো যাবে না। এটা আসলে একটা চক্র।”

পশ্চিমবঙ্গের শিল্প এখন বাস্তবিকই এই ভুলভুলাইয়ায় ঢুকে পাক খাচ্ছে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement