তিন বছর ধরে বিরোধীরা লাগাতার হইচই করে চলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী নির্ধারিত দিনে বিধানসভায় আসেন না। তাঁর হাতে-থাকা দফতরগুলি নিয়ে কোনও প্রশ্নেরও জবাব দেন না। এ বার বিধানসভায় দাঁড়িয়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাফ জানিয়ে দিলেন, অধিবেশন চলাকালীন তিনি আসবেন তাঁর ইচ্ছামতো! প্রশ্ন থাকলে প্রয়োজনে আসবেন। নচেৎ নয়!
স্বাধীনতার পর থেকে এ রাজ্যের কোনও মুখ্যমন্ত্রীই এ ভাবে বিধানসভার কাজকর্মকে অবহেলা করেননি বলে বিরোধীদের দাবি। এমনিতেই মুখ্যমন্ত্রী প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না বলে শুক্রবার অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করেছিলেন প্রধান বিরোধী পক্ষ বামফ্রন্টের বিধায়কেরা। মুলতবি প্রস্তাব না মানা এবং মুখ্যমন্ত্রীর জবাব না পাওয়ার প্রতিবাদে বেরিয়ে গিয়েছিলেন কংগ্রেস বিধায়কেরাও। বিরোধীশূন্য বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী এ দিন যে ভাবে যখন খুশি আসার কথা জানিয়ে দিয়েছেন, পরে তা শুনে স্তম্ভিত বিরোধীরা! শাসক পক্ষের বিধায়কদেরও অনেকে অস্বস্তি আড়াল করতে পারছেন না। কারণ, সরকারি দফতর নিয়ে শাসক দলের বিধায়কদেরও প্রশ্ন থাকে। অথচ তিন বছরে আইনশৃঙ্খলার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একটি প্রশ্নেরও উত্তর বিধানসভায় আসেনি!
বাম ও কংগ্রেস বিধায়কেরা এক দিকে যেমন বিধানসভার প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তেমনই প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাঁর দাবির বিরুদ্ধেও। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, প্রশ্ন না-থাকলে আসবেন কেন? ঘটনা হল, তিন বছরে আইনশৃঙ্খলা, ভূমি, স্বাস্থ্য, তথ্য ও সংস্কৃতি-সহ মুখ্যমন্ত্রীর হাতে-থাকা ৮টি দফতরের বিষয়ে অজস্র প্রশ্ন জমা দিয়েছেন বিরোধীরা। মুখ্যমন্ত্রীর জন্য প্রশ্নোত্তর-পর্ব থাকবে না বলে চলতি অধিবেশনে তাঁর জন্য প্রশ্ন নেওয়াই হচ্ছে না। জমা দেওয়া প্রশ্ন সভায় পেশ করার (টেব্ল করা) দায়িত্বও বিরোধীদের নয়। তা হলে আর প্রশ্ন না থাকলে আসব কেন, এ কথা বলার কী যুক্তি প্রশ্ন বিস্মিত বিরোধীদের!
মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভায় হাজির থাকার ও প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার নির্ধারিত দিন এখন শুক্রবার। বাম জমানায় জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জন্য যা ছিল বৃহস্পতিবার। মুখ্যমন্ত্রী কেন সভায় এসে প্রশ্নের উত্তর দেবেন না, এই দাবিতে এ দিন অধিবেশনের প্রথমার্ধে ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখান বাম বিধায়কেরা। অন্য কোনও প্রশ্ন না-করে তাঁরা এক সময় ওয়াক আউট করে বেরিয়েও যান। এর পরে বহরমপুর কলেজে গোলমালের ঘটনা নিয়ে মুলতবি প্রস্তাব আনতে গিয়ে কংগ্রেস বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তীও প্রশ্ন তোলেন, মুখ্যমন্ত্রী কেন প্রশ্নের উত্তর দেন না? তখনই সভায় আসেন মুখ্যমন্ত্রী।
এই সময় কিছু বলতে চেয়েছিলেন কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব। কিন্তু কোনও অনুমতিই না পেয়ে কংগ্রেস বিধায়কেরা সভা ছেড়ে বেরিয়ে যান। এর পরে উল্লেখ-পর্ব শেষ হলে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই সভায় অনুপস্থিত বিরোধীদের উদ্দেশে বলেন, “ধৈর্য নেই! মুখ্যমন্ত্রী তো সভায় উপস্থিত! অধিবেশনে একাধিক বার এসেছেন। স্বরাষ্ট্র দফতরের বাজেটের সময় উত্তরও দিয়েছেন। ওঁদের আরও সহনশীল হওয়া উচিত।” স্পিকার যখন প্রথমার্ধের কাজ মুলতবি করে বিরতি ঘোষণা করছেন, তখনই উঠে দাঁড়ান মুখ্যমন্ত্রী। বলেন, “নিজেরা প্রশ্ন করতে পারে না! প্রশ্ন না দিলে উত্তর দেব কী করে?” তাঁর আরও বক্তব্য, “একটা প্রশ্ন করেছিল জমি নিয়ে। সেটা বিচারধীন থাকায় তা তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন না থাকলে যখন খুশি আসব!” প্রসঙ্গত, আগে এক বার মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, বিধানসভায় আসার থেকে জেলায় জেলায় ঘোরা তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের মন্তব্যের পরে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য, “তিন বছর ধরে আমরা প্রশ্ন করে করে হদ্দ হয়ে গিয়েছি! কোনও প্রশ্নের জবাব পাইনি। এখন তো প্রশ্ন নেওয়াও হচ্ছে না। তার পরে যদি উনি এসে বলেন প্রশ্ন না থাকলে কী করব, তা হলে আমরাই বা কী করব!” কংগ্রেসের বর্ষীয়ান বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার প্রতিক্রিয়া, “অহেতুক বিরোধীদের সমালোচনা করে নিজের দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করবেন না! মুখ্যমন্ত্রীকে বলব, স্পিকারের দেওয়া সবুজ রঙের বইটি পড়ে নিন। কার কী ভূমিকা, বিধায়কদের কী অধিকার, সব তা হলে জেনে নিতে পারবেন!”
প্রথমার্ধের অধিবেশন ‘মুলতবি’ করার সময় কী ভাবে মুখ্যমন্ত্রীকে বলার অনুমতি দেওয়া হল তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সূর্যবাবু, মনোজবাবুরা। তবে সে প্রশ্নকেও ছাপিয়ে গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক। মানসবাবু যেমন বলেছেন, “বিধানচন্দ্র রায় থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পর্যন্ত সব মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় এসে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। এখন দেখছি, সব উল্টো চলছে!” পরিষদীয় ইতিহাসবিদ দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় উদাহরণ দিচ্ছেন, ১৯৭১ সালে অজয় মুখোপাধ্যায়ের তিন মাসের সরকারের আমলে মাত্র ১০ দিনের একটি অধিবেশন হয়েছিল। তার মধ্যে অনাস্থা প্রস্তাব এসেছিল, রীতিমাফিক প্রশ্নের উত্তরও হয়েছিল। প্রশ্ন নেওয়া হবে না এবং মুখ্যমন্ত্রী যখন খুশি আসবেন, এমন কথা কখনওই শোনা যায়নি!