উত্তাল: কাশ্মীরে নতুন সরকার সে রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা ফেরানোর প্রস্তাব পাশ করায় বিজেপি বিধায়কদের বিক্ষোভ। ৮ নভেম্বর, শ্রীনগর। ছবি: পিটিআই।
একই সঙ্গে দুটো যুদ্ধ চলছে— রাশিয়া বনাম ইউক্রেন আর ইজ়রায়েল বনাম প্যালেস্টাইন। নির্বাচনী গণতন্ত্র আর ধনতন্ত্রের জোড়া বিজয়রথে সওয়ার প্রথম বিশ্ব দুটো যুদ্ধ সম্বন্ধেই এমন শীতল ভাবে নিস্পৃহ যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেই মনে হচ্ছে গোটা দুনিয়ার শান্তিদূত। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভক্তরা মাঝেমধ্যে দাবিও করেন যে, তাঁকে শান্তির নোবেল পুরস্কারটি দেওয়া হবে, আজ না হোক পরশুর পরের দিন। তবে নিজের ঘরের বিষয়গুলো একেবারে এড়িয়ে গিয়ে শান্তির নোবেল হয় কি না, জানা নেই। প্রধানমন্ত্রী মণিপুরের কথা ভুলেও বলেন না। চলুন, তাঁর সেই বিস্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে আমরাও আপাতত মণিপুরের কথা বাদ দিই। কাশ্মীরের কথা বলি।
রাজ্যের সম্মান হারানো জম্মু-কাশ্মীরে ২০২৪ বিধানসভা নির্বাচনের পর অধিবেশনের শুরু থেকেই ধস্তাধস্তি চলছে। বিষয় কিন্তু আগামীর কোনও নির্দিষ্ট উন্নয়নমূলক আলোচনা নয়, বরং মানুষের অধিকারের। এই সব অধিকার নম্বর-সহকারে সংবিধানে লেখা থাকে। জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের ক্ষেত্রে তা ছিল ৩৭০ ধারা আর ৩৫এ ধারায়। অতীতে দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় কয়েকটি অতিরিক্ত সুবিধা ছিল কাশ্মীরের ভূমিপুত্রদের— ২০১৯ সাল থেকে সে সব তামাদি। অন্যান্য রাজ্যে যদিও এ রকম কিছু ধারা টিকে আছে। যেমন ৩৭১ ধারার এ থেকে জে, এই দশটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে মহারাষ্ট্র, গুজরাত, নাগাল্যান্ড, অসম, মণিপুর, অন্ধ্রপ্রদেশ, সিকিম, মিজ়োরাম, অরুণাচল প্রদেশ, গোয়া এবং কর্নাটকের বিভিন্ন পিছিয়ে থাকা অংশের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধার কথা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী ছাড়া অন্যদের এ সব পড়ে দেখার প্রয়োজন হয় না, কারণ রাজনীতিতে এর মূল্য কম। অন্য দিকে, জম্মু-কাশ্মীর অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেখানে হিন্দু-মুসলমান আছে; পাকিস্তানও আছে।
ভারতের গৈরিক জাতীয়তাবাদীরা কাশ্মীরের প্রশ্নে কোনও কালেই মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী নন। অবশ্য, সরাসরি ‘হাল্লা চলেছে যুদ্ধে’ বললে গোটা দুনিয়াতেই এখন বেশি ভোট পাওয়া যায়। সেই অঙ্কে ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির চারশো আসন পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কোনও কারণে এ দেশের নির্বাচককুল তেমনটা ঘটতে দেননি। তুলনায় তাদের জয় বৃহত্তর ছিল ২০১৯ সালে। সেই জনাদেশ বিজেপি ব্যর্থ হতে দেয়নি— ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বার দিল্লির মসনদে আসীন হয়েই তারা নিজেদের নির্বাচনী ইস্তাহার অনুযায়ী সংবিধানের ৩৭০ আর ৩৫এ ধারা বিলোপ করে। এখানেই একটা প্রশ্ন মনে আসে— সে সময় বিজেপি কি নিজেদের জয়ের নিরিখে মোটের উপরে নিশ্চিত ছিল যে, জম্মু-কাশ্মীর মিলিয়ে যে অঞ্চল, সেখানে বিধানসভা নির্বাচন হলে তারা সহজেই জিতবে?
না হলে অন্য অঙ্ক তো কষাই যেতে পারত। লাদাখ যেমন ভিন্ন হয়েছে, তেমনই জম্মু আর কাশ্মীরকে আলাদা করলে অন্তত জম্মুতে বিজেপির জেতা নিশ্চিত হত। যদিও রাষ্ট্রবাদী বিজেপির পক্ষে এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া শক্ত, কারণ কাশ্মীরকে আলাদা করলে গণতান্ত্রিক পথেও তা বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির হাতে চলে যেতে পারে। ফলে জম্মু-কাশ্মীর এক সঙ্গেই রইল, আর সংসদীয় ব্যবস্থার ফাঁক গলে যেটুকু সুবিধা নেওয়া যায়, সেই আসন পুনর্বিন্যাসে জম্মুতে বাড়ল ছ’টি আসন, কাশ্মীরে একটি। সঙ্গে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের ক্ষমতায় রাখা হল পাঁচটি আসন, যাতে বিজেপির হাতেই ওই বাড়তি পাঁচটি আসনও থাকে।
২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ধাক্কা খাওয়ায় আশঙ্কা তৈরিই হয়েছিল যে, জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচনেও দল অভীষ্ট ফলাফলে পৌঁছতে পারবে না। একই সঙ্গে ধর্মের ক্ষেত্রে লঘু-গুরু বিভাজনের মতোই জম্মু আর কাশ্মীরের বিভাজন আর এক বার পরিষ্কার হয়ে গেল এই নির্বাচনে। আর বিধানসভা বসার পরেই ধুন্ধুমার কাণ্ড। পুনরায় পুরনো সুবিধা এবং একই সঙ্গে রাজ্যের মর্যাদা পাওয়ার দাবি উঠল বিধানসভার মধ্যে থেকে, গৃহীত হল সেই সংক্রান্ত দাবিসনদ। স্বভাবতই তার বিরুদ্ধে বিজেপি বিধায়কদের তুমুল হইচই, তাঁদেরকে মার্শালেরা টেনে হিঁচড়ে বার করে দিলেন।
জনাদেশে ক্ষমতায় আসীন হয়েও কেন ওমর আবদুল্লা নিজেকে ‘ভারতের সবচেয়ে কম ক্ষমতাশালী মুখ্যমন্ত্রী’ মনে করছেন? বিধানসভা নির্বাচন হল, সেখানে বিজেপি হারল, শুরুর দিকের অধিবেশনে কাশ্মীরের জনগণের কথা মাথায় রেখে শাসক ন্যাশনাল কনফারেন্স (জোট ধরলে সঙ্গে অল্প ক’জন কংগ্রেস বিধায়ক, আর পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বেশি আসন পাওয়া সিপিএম) তাদের পুরনো সুযোগ-সুবিধা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি তুলল, বিজেপি বিধায়করা তার প্রতিবাদে তুলকালাম করলেন, সব মিলিয়ে এক দুর্দান্ত গণতন্ত্রের কোলাজ ফুটে উঠল। কিন্তু, কাশ্মীরের ছবিটিকে একটু ভেঙে দেখলেই স্পষ্ট হবে যে, এ নেহাতই ‘ছদ্ম গণতন্ত্র’।
কারণ, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেল কেন্দ্রের হাতে। সেই নিয়ন্ত্রণের পথটি লেফটেন্যান্ট গভর্নরের দরজা ছুঁয়েই যায়। তাঁর হাতে পাঁচ বিধায়ক নির্বাচনের ক্ষমতা তো বটেই, রাজ্যের চালিকাশক্তিও শেষ অবধি তাঁরই কুক্ষিগত থাকবে। ফলে, জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভায় যে তোলপাড় চলছে, গণতন্ত্রের যে ‘অনুশীলন’ ঘটছে, শেষ অবধি তা হচ্ছে এবং হবে কেন্দ্রের বিস্তৃত ক্ষমতাবলয়ের মধ্যেই, কার্যত পুতুলনাচের মতো। এর ইতিবাচক দিক অবশ্যই বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে সামলে রাখা। এক দিকে যেমন রাষ্ট্রীয় শক্তির আধিপত্যবাদের প্রশ্ন ওঠে কাশ্মীরে, অন্য দিকে ভারত সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করে যে, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। উদ্দেশ্য যদি হয় দেশের এই অংশকে কড়া নজরে রাখা, সে ক্ষেত্রে এই ধরনের ছদ্ম গণতন্ত্র অবশ্যই এক সফল রাজনৈতিক কৌশল। বিজেপির সঙ্গে পিডিপির জোট নিয়ে (২০১৫-১৮) তথাকথিত বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রবাদী দলের সমীকরণের প্রসঙ্গ আলোচিত হয় বার বার। এ বারেও তার থেকে পুরোপুরি বেরোনো গেছে, সে কথা বলা যাবে না।
নির্বাচনের আগে জামিনে ছাড়া পান শেখ আব্দুল রশিদ (ইঞ্জিনিয়ার রশিদ নামে বেশি পরিচিত, দলের নাম জম্মু ও কাশ্মীর আওয়ামি ইত্তেহাদ পার্টি), গত মে মাসে যিনি লোকসভা নির্বাচনে বারামুলা থেকে জিতেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের। নিন্দুকেরা বলেন যে, রশিদকে ছেড়ে দিয়ে আসলে ন্যাশনাল কনফারেন্সের ভোট ভাঙতে চেয়েছিল বিজেপি। প্রতিবাদী মানুষকে ভোটের আগে জেল থেকে ছাড়া হল, তিনি প্রচার করলেন কাশ্মীর জুড়ে— এর পরেও গণতন্ত্রের পরিবেশ নেই, এ কথা তো আর কেন্দ্রের শাসক দলের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলা যাবে না। গণতন্ত্রের এমনই মহিমা, কুলগামে ভোটে হারা জামাতের সায়াদ আহমেদ রেশি অভিযোগ এনেছেন যে, জয়ী সিপিআইএম প্রার্থী তারিগামির সমর্থকেরা নাকি তাঁকে পটকা ফাটিয়ে বিরক্ত করেছেন। সত্যিই মনে হয় এর পর কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে নতুন ভাবনার সময় আসন্ন— যেখানে গ্রেনেড নয়, পটকা ফাটানো নিয়ে অভিযোগ আসে!
আসলে গণতন্ত্রের মূল শর্ত যৌক্তিক বিরোধিতা সামনে আনা এবং আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করা— গম্ভীর ইংরেজিতে যাকে ‘থিসিস-অ্যান্টিথিসিস-সিন্থেসিস’ বলা যেতে পারে। কিছুটা ধস্তাধস্তি হলেও, জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা আপাতত সেই দ্বন্দ্বটুকু সফল ভাবে সামনে আনছে। এখানে হিন্দু বনাম মুসলিম, কাশ্মীর উপত্যকা বনাম জম্মু, ন্যাশনাল কনফারেন্স বনাম বিজেপি, জাতীয়তাবাদী বনাম বিচ্ছিন্নতাবাদী— রাজনীতির পুতুলনাচ যেমন দেখানো হবে, আমরা তেমনই দেখব। তবু দিনের শেষে একটা প্রশ্ন থেকেই যাবে— সেখানকার মানুষগুলো ঠিক কী চাইছেন, সেটা রাষ্ট্রব্যবস্থা অনুধাবন করতে পারছে তো? অবশ্যই বিধানসভা নির্বাচন কোনও গণভোট নয়। সঙ্গে এ কথা নির্দিষ্ট করে বার বার বলা প্রয়োজন যে, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু সেই জায়গার মানুষ যদি বহু বছর উন্নয়নের আলো থেকে বঞ্চিত হন, সেই অঞ্চলের সম্পদের লোভে যদি হানা দেয় বহুজাতিক বেনিয়ারা, সে ক্ষেত্রে ছদ্ম গণতন্ত্রের সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। উত্তরবঙ্গ থেকে দেশের উত্তর-পূর্বের ছোট ছোট রাজ্য— কাশ্মীরের মতোই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ কিন্তু স্বাধীনতার সাতাত্তর বছর পরেও রয়ে যাচ্ছে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা।
(মতামত ব্যক্তিগত)