পরিকল্পনা আর পরিকাঠামো বদলে আয়বৃদ্ধির দিশা পেয়েছে দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগম (এসবিএসটিসি)।
গত বছর যেখানে এসবিএসটিসি-তে কিলোমিটার-পিছু বাসের আয় (ইপিকেএম) ছিল ১৭ টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ২১.৮০ টাকা। এক বছর বাদে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছে ২৫ টাকা। প্রতি মাসে নিগমের আয় পাঁচ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬.৭৫ কোটি টাকা। এক বছর বাদে পরিমাণটা ৭.৫০ কোটি টাকা করার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে।
সামগ্রিক ভাবে যাত্রী-পরিবহণ ব্যবস্থা যেখানে সঙ্কটে, সেখানে এসবিএসটিসি-র সাফল্যের চাবিকাঠি কী? পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, মূলত তিনটি পথে এই সাফল্য এসেছে। সেগুলি হল: ১) টেন্ডার ডেকে পিপিপি (প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ) মডেলে কিছু বাস চালানোর দায়িত্ব দেওয়া, ২) বসে থাকা বাস সারাই ও মানোন্নয়ন করে ‘ডিলাক্স’ হিসেবে চালানো, ৩) বাড়তি যাত্রী ধরতে ডিপোয় কমিশনভিত্তিক ‘বুকিং এজেন্ট’ নিয়োগ।
দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগম (এসবিএসটিসি)। নিগমের চেয়ারম্যান তমোনাশ ঘোষের বক্তব্য, “মূল লক্ষ্য, বাসের আয় অর্থাৎ ইপিকেএম বাড়ানো। এ ভাবে কিছু রুটের বাস হস্তান্তরিত হয়েছে। সেই রুটগুলিতে ইপিকেএম ১৭ টাকা থেকে বেড়ে ২৪ টাকা হয়েছে।” তিনি জানান, পশ্চিম মেদিনীপুরের সাঁকরাইল, পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না-র মতো কিছু ব্লকের বিডিও ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে বাস নিয়েছেন। আরও কয়েকজন খোঁজ করছেন।
সাফল্যের চাবিকাঠি মেলে গত বছর অগস্টে। ওই মাসের গোড়ায় মেদিনীপুর-রোহিণী রুটের বাসটি ‘অলাভজনক’ বলে চালানো বন্ধ করে এসবিএসটিসি। জেলা সদর মেদিনীপুর এবং সাঁকরাইলের ব্লক সদর রোহিণীর মধ্যে যাতায়াতকারী বাসটির উপরে বহু মানুষ নির্ভরশীল। যাত্রীদের কথা ভেবে বাস চালানোর দায়িত্ব নেন সাঁকরাইলের বিডিও সৌরভ চট্টোপাধ্যায়। স্থানীয় বেকার যুবকদের দিয়ে পিপিপি মডেলে বাস চালানোর ব্যবস্থা হয়। গত অগস্টের মাঝ থেকেই ফের পথে নামে মেদিনীপুর-রোহিণী রুটের বাস। এক মাস বাদে ওই যুবকেরা লভ্যাংশ রেখে উদ্বৃত্ত ১৫ হাজার টাকা বিডিও-কে দেন। তাঁদের দাবি, ঠিকা চালক ও কর্মী দিয়েই বাস চালিয়ে তাঁরা লাভ করেছেন। মেদিনীপুর-রোহিণী রুট-এর সেই বাস এখনও বহাল তবিয়তে চলছে।
এ রকমই শিয়ালদহ-হাওড়া রুটে বাস নিয়েছেন প্রদীপ রায়, অশোক দেবরা। সাত মাস ধরে পাঁচটি বাস চালাচ্ছেন অশোক, মাস ছয় ধরে পাঁচটি বাস চালাচ্ছেন প্রদীপ। তাঁরাও নিজেদের লভ্যাংশ রেখে নিগমকে মাসে মাসে টাকা দিচ্ছেন। সাফল্যের এই নিদর্শনই উৎসাহিত করে নিগমকে। এ কথা জানিয়ে নিগমের ট্রাফিক ম্যানেজার উজ্জ্বল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “এ রকম গোটা কুড়ি নতুন বাস এ ভাবেই ফ্র্যাঞ্চাইজি দিয়েছি।”
বেসরকারি উদ্যোগে যদি বাস চালিয়ে লাভ করা যায়, আপনারা পারছেন না কেন? নিগমের এক পদস্থ অফিসার স্বীকার করেন, “সাধারণ কর্মীদের দায়বদ্ধতা নেই। ‘আসি-যাই মাইনে পাই’ গোছের মানসিকতা গভীর ভাবে বসে গিয়েছে সর্বস্তরে। সে কারণে এই হাল।” এসবিএসটিসি-র চেয়ারম্যান বলেন, “আমাদের চালক-কন্ডাক্টরদের অধিকাংশই বয়স্ক। কর্মসংস্কৃতির মান ভাল করতে আমরা নানা ভাবে চেষ্টা করছি। আর বেসরকারি উদ্যোগে বাস চালিয়ে লাভের এই নজির আমরা নিগমের চালক-কন্ডাক্টরদের কাছে রেখে প্রশ্ন করার সুযোগও এখন পাচ্ছি।”
বসে যাওয়া বাসের মেরামতি ও মানোন্নয়ন করে সেগুলোকে ‘ডিলাক্স’ তকমা দেওয়াও আয় বাড়ানোয় কাজে এসেছে বলে নিগম কর্তৃপক্ষের দাবি। এ রকম ৫৪ আসনের প্রতিটি বাসে ২’ x ৩’ মাপের ‘পুশব্যাক চেয়ার’, ‘সাউন্ড সিস্টেম’ বসানো হয়েছে। জানলায় লাগানো হয়েছে নতুন পর্দা। কর্তৃপক্ষের হিসেব, “বসে থাকা বাসগুলো ডিলাক্স-এ উন্নীত করতে প্রতিটির জন্য প্রায় তিন লক্ষ টাকা খরচ করতে হয়েছে।” কলকাতা থেকে বর্ধমান-দুর্গাপুর, পুরুলিয়া, আসানসোল, বাঁকুড়ার বিভিন্ন রুটে যাত্রীরা এই বাসগুলোকে স্বাগত জানাচ্ছেন দাবি করে নিগম চেয়ারম্যান বলেন, “এ রকম ২০টি ডিলাক্স বাস নামিয়েছি। আরও ২০টি নামানোর তোড়জোড় চলছে।” নিগম সূত্রের খবর, বেসরকারি নানা রুটের সঙ্গে পাল্লা দিতে কমিশনভিত্তিক ‘বুকিং এজেন্ট’ নিয়োগ করেও সুফল মিলেছে। ট্রাফিক ম্যানেজার উজ্জ্বলবাবুর কথায়, “সম্প্রতি বালুরঘাট, গঙ্গারামপুর, মালদহ, বহরমপুর, হলদিয়া এবং মেদিনীপুর শহরে এ রকম এজেন্ট নিয়োগ করে সুফল পেয়েছে নিগম।” আগামী কয়েক মাসে আরও কিছু ডিপোয় বুকিং এজেন্ট নিয়োগ হবে।
ষাটের দশকে গড়ে ওঠা এসবিএসটিসি প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই মূলত সরকারি ভর্তুকির উপরে নির্ভরশীল ছিল। পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “নিগমগুলোকে স্বাবলম্বী হতে বলেছি। তাতে সাড়া আসছে দেখে আমরা খুশি।”