পিজি হাসপাতালের পথে আহত দেবাশিস আচার্য। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে তাঁর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় গণপিটুনিতে জখম দেবাশিস আচার্যের বাবা-মায়ের সঙ্গে বুধবার দেখা করেছিলেন।
তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, বৃহস্পতিবার ‘উন্নত পরিষেবা’র জন্য দেবাশিসকে এসএসকেএমে নিয়ে আসা হল সেই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই। এবং সাধারণ কোনও শয্যা নয়, তাঁর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে কেবিন।
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, পূর্ব মেদিনীপুরের চণ্ডীপুরের সভামঞ্চে অভিষেককে চড় মারার ঘটনায় দেবাশিসের মা-বাবা ক্ষমা চাওয়ার জন্য তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের সেই ইচ্ছার কথা জানতে পেরে মঙ্গলবার রাতেই অভিষককে তাঁদের সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দেন মমতা। সেই অনুযায়ী অভিষেক বুধবার তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। দেবাশিসের বাবা-মা তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। তাঁরা যে ছেলেকে এসএসকেএমে এনে চিকিৎসা করানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, সেটাও ভাইপো মারফত জানতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরেই নবান্ন থেকে ফোন যায় স্বাস্থ্য ভবনে। তমলুক হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে দেবাশিসের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে যদি তাঁকে কলকাতায় আনা সম্ভব হয়, তা হলে দ্রুত সেই ব্যবস্থা করার জন্য স্বাস্থ্যকর্তাদের নির্দেশ দেন মমতা। স্বাস্থ্য ভবন থেকে নির্দেশ যায় তমলুক হাসপাতাল এবং এসএসকেএমে।
পিজি-কর্তৃপক্ষ প্রথমে দেবাশিসের জন্য শয্যা বরাদ্দ করেন কার্জন ওয়ার্ডে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, তার পরে ফের নবান্ন থেকেই তাঁদের এমন কোনও শয্যার বন্দোবস্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়, যেখানে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে দেবাশিসকে দূরে রাখতেই এমন প্রচেষ্টা বলে পিজি-কর্তারা মনে করছেন। তাঁরা রিউম্যাটোলজি বিভাগের কেবিন বরাদ্দ করেন। জেনারেল সার্জারি বিভাগের অমিতাভ সরকারের অধীনে ভর্তি করানো হয় দেবাশিসকে। ওই কেবিনেই ভর্তি ছিল খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত আব্দুল হাকিম।
গত রবিবার চড়-কাণ্ডের পর থেকেই গণপিটুনিতে জখম দেবাশিস তমলুক জেলা হাসপাতালের মেল মেডিক্যাল বিভাগে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর কাছে সর্বক্ষণ মোতায়েন ছিল পুলিশ। হাসপাতালের প্রবেশপথ এবং চত্বরেও পুলিশি পাহারা ছিল। সংবাদমাধ্যমকে এড়ানোর জন্য এ দিন সেই বন্দোবস্ত আরও আঁটোসাঁটো করা হয়। গোটা হাসপাতাল চত্বর ছয়লাপ ছিল পুলিশে। প্রধান গেটে সাংবাদিক এবং বহু উৎসাহী মানুষ অপেক্ষায় ছিলেন। সকলকে ফাঁকি দিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে বার করে অ্যাম্বুলান্সে তোলা হয় দেবাশিসকে। সামনের গেটে ট্রলিতে চাদর চাপা দিয়ে অন্য এক জনকে বার করা হয়।
এত গোপনতা কেন?
“এতে আমাদের কোনও ভূমিকা নেই। কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য নিয়ম মেনে রোগীকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কথা। তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী যা করার করা হয়েছে,” জবাব জেলা হাসপাতালের সুপার গোপাল দাসের। এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সুকেশকুমার জৈন।
এ দিন সকালেই দেবাশিসের কাছে চলে আসেন তাঁর মা শিবানী আচার্য। জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রোগীকে পিজি-তে পাঠানোর সুপারিশ করার পরে পুলিশই গোটা বিষয়টির ভার নেয়। বিকেল সওয়া ৪টে নাগাদ পুলিশি প্রহরায় পিজি-র জরুরি বিভাগে পৌঁছন দেবাশিস। সঙ্গে ছিলেন শিবানীদেবীও। চোখের কোলে ঘোর কালশিটে। রক্ত জমে ঠোঁট ফুলে রয়েছে। মাথার বেশ কিছু অংশ কামানো। চোখ বুজে স্ট্রেচারে শুয়ে ছিলেন দেবাশিস।
কেন তিনি এমন কাজ (চড় মারা) করলেন, সাংবাদিকেরা সেই প্রশ্ন করায় দেবাশিস মুখ ঘুরিয়ে নেন। শিবানীদেবী বারবার অনুরোধ জানাতে থাকেন, তাঁর ছেলেকে যেন আর কোনও বিতর্কে জড়ানো না-হয়। মিনিট দশেক পরেই জরুরি বিভাগ থেকে দেবাশিসকে নিয়ে যাওয়া হয় রিউম্যাটোলজি বিল্ডিংয়ের কেবিনে। ওই বিভাগের কর্মীরা জানান, ভর্তির পর থেকে কারও সঙ্গেই বিশেষ কথা বলেননি দেবাশিস। আচ্ছন্নের মতো শুয়ে আছেন। মাঝেমধ্যে বিড়বিড় করেছেন নিজের মনেই।
চিকিৎসকেরা জানান, শরীরের কিছু অংশে গুরুতর আঘাত রয়েছে দেবাশিসের। আজ, শুক্রবার তাঁর বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা হবে। তার ভিত্তিতেই অস্ত্রোপচার প্রয়োজন কি না, সেই সিদ্ধান্ত হবে। প্রয়োজনে নেওয়া হবে মনোবিদের সহায়তা। পিজি-র অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র জানান, তমলুক হাসপাতালে কী পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে, কী ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল সব কিছু খতিয়ে দেখে এখানে চিকিৎসা প্রক্রিয়া শুরু হবে।