বাম জমানায় ছিলেন বামেদের ঘনিষ্ঠ। তৃণমূলের রমরমার সময় তৃণমূলের। এখন তিনি কোথায়?
ভাইচুং ভুটিয়া। তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা থেকে নিজের কোনও পাওনা আদায়, বহু ক্ষেত্রেই যোগসূত্র ছিলেন মদন মিত্র। যে কারণে এক সময়ে প্রায়ই তাঁকে দেখা যেত ক্রীড়া ও পরিবহণমন্ত্রীর দফতরে। কিন্তু ১২ ডিসেম্বর মদন গ্রেফতার হওয়ার পর দিনই মমতা বন্দ্যোপাধায়ের নির্দেশে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ খেলোয়াড়রা যখন ধর্নায় বসলেন, তখন কিন্তু এক বারের জন্যেও সেখানে মুখ দেখাননি তিনি!
সারদা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত মন্ত্রীকে গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানাতে গোষ্ঠ পালের মূর্তির নীচে জড়ো হতে দেখা গিয়েছে প্রাক্তন ফুটবলার গৌতম সরকার, শ্যাম থাপা, দীপেন্দু বিশ্বাস-সহ আরও অনেককেই। এমনকী, ধর্না-মঞ্চ ভরাতে খেলোয়াড় তকমা দিয়ে কচিকাঁচাদের টেনে এনেও যখন মুখরক্ষা করা যাচ্ছে না, সেই পরিস্থিতিতেও গোষ্ঠ পালের মূর্তির ধার মাড়াননি ভারতীয় ফুটবল দলের এই প্রাক্তন অধিনায়ক।
এমন নয় যে ধর্নার সাতটা দিনই ভিন্ শহরে অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন। গত ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর কলকাতাতেই ছিলেন ভাইচুং। সাইডলাইনের ধার ঘেঁষে নিজের কাজটি সেরে চলে গিয়েছেন। ১৮ তারিখ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ধর্না-মঞ্চ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্ব দিয়ে পাঁচটার সময়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান তিনি। ফলে কিছু দিন আগে পর্যন্ত যিনি ছিলেন তৃণমূলের একেবারে ঘরের ছেলে, সেই ভাইচুংই এখন শাসক দলের অন্দরে সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্র। তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন, ভাইচুং ভুটিয়া মদনদার সমর্থনে ওই মঞ্চে যোগ দিন। তাতে আমাদের প্রতিবাদ অন্য মাত্রা পেত। কিন্তু ও এক দিনও এল না। এমনকী, কোনও বার্তাও পাঠায়নি। আমরা সত্যিই হতাশ।” তৃণমূলের ওই শীর্ষ নেতার কথায়, “দুঃখের দিনেই আসল বন্ধু চেনা যায়। ভাইচুংকে দেখে সেটাই টের পাচ্ছি।”
কিন্তু এখন কেন ভাইচুং তৃণমূলের ছোঁয়া এড়িয়ে চলতে মরিয়া?
প্রশ্নটা এড়িয়ে যাচ্ছেন শাসক দলের লোকজন। কিন্তু ময়দানের একটি সূত্র জানাচ্ছে, একটি বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে ইতিমধ্যেই ভাইচুংয়ের নাম জড়িয়ে গিয়েছে। ভাইচুংয়ের ক্লাব ইউনাইটেড সিকিমের অন্যতম স্পনসর ছিল ওই বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা। সেই সূত্রে সোমবার সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস (এসএফআইও)-র অফিসাররা সোমবারই দিল্লিতে জেরা করেছেন ভাইচুংকে। এই অবস্থায় সারদায় জর্জরিত শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে নিজের নাম জড়িয়ে আর নতুন করে বিতর্ক তৈরি করতে চান না তিনি। সেই কারণেই সযত্নে তৃণমূলের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলছেন।
এসএফআইও সূত্রের খবর, এ দিন জেরায় তদন্তকারীরা ভাইচুং ও তাঁর ক্লাবের সঙ্গে ওই সংস্থার চুক্তির বিস্তারিত জানতে চান। এমনকী, নেতাজি ইন্ডোরে ওই সংস্থার অনুষ্ঠানে ভাইচুং যে উপস্থিত ছিলেন, সে বিষয়েও বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন তাঁরা। এ ব্যাপারে ভাইচুংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “ওই স্পনসরের বিস্তারিত তথ্য আমরা এসএফআইও-র কাছে জমা দিয়েছি। ওই সংস্থার জন্য আমাদের ক্লাব দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে। ওই সংস্থার কাছ থেকে আমরা এখনও ১.৯ কোটি টাকা পাই। তাই আমরা এসএফআইও-কে অনুরোধ করেছি, যাতে বাকি অর্থ ওই সংস্থার কাছ থেকে আদায় করতে ওরা আমাদের সাহায্য করে।” শাসক দলের সংস্পর্শ এড়িয়ে যাওয়া নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি ভারতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক।
তৃণমূলের নেতারা জানাচ্ছেন, শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হওয়ার বেশ কিছু সুবিধে পেয়েছেন ভাইচুং। তৃণমূল সূত্রের খবর, গত লোকসভা ভোটে মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে চেয়েছিলেন, সিকিম থেকে প্রার্থী হোন ভাইচুং আর দার্জিলিঙে প্রার্থী হোন আর এক প্রাক্তন ফুটবলার শ্যাম থাপা। কিন্তু সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিংয়ের বিরুদ্ধে যাবেন না বলে ভাইচুং সিকিমে প্রার্থী হতে চাননি। এর মধ্যেই শ্যাম থাপা মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তখন ভাইচুং-ই মমতাকে দার্জিলিং কেন্দ্রে লড়ার ইচ্ছেপ্রকাশ করেন। ভোটে অবশ্য হেরে যান ভাইচুং। পরে মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে উত্তরবঙ্গ ক্রীড়া উপদেষ্টা বোর্ডের চেয়ারম্যান করেন। এখনও ওই পদে রয়েছেন।
এখানেই শেষ নয়। মদন-ঘনিষ্ঠ তৃণমূলের এক নেতা বলেন, “যে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে ভাইচুংয়ের গলাগলি সম্পর্ক ছিল, ওই সংস্থাই তাঁকে বিজ্ঞাপনের ৪০ লক্ষেরও বেশি টাকা দিতে চাইছিল না। সে সময়েও ভাইচুং মদনদার দ্বারস্থ হন। মদনদা ওই সংস্থার সঙ্গে কথা বলে সেই টাকা পাইয়ে দেন ভাইচুংকে। এখন মদনদা যখন বিপদে পড়েছেন, সেই ভাইচুং-ই এড়িয়ে যাচ্ছেন।”
ভাইচুংয়ের সঙ্গে ক্লাব খেলেছেন এমন এক ফুটবলারের কথায়, “এ রাজ্যে পালাবদলের আগে পর্যন্ত সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন ভাইচুং। এমনকী, তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল ছিল। কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পরে ভাইচুং-ও বর্তমান শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তার সূত্র সেই মদন মিত্রই।”