মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন শুক্রবার। নবান্নের ১৪ তলায় খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে বৈঠকের জন্য তাঁর ডাক পড়ল শনিবার। আনুষ্ঠানিক উপলক্ষ, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রস্তুতি।
তৃণমূলের অন্দরে গুঞ্জন, তবে কি পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র শাপমুক্ত হলেন?
অথচ, সারদা কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়ে যাওয়ায় মাস দুয়েক আগে চিত্রটা ছিল একেবারেই অন্য রকম। তখন মদনের ছায়াও এড়িয়ে চলতে চাইছিলেন মমতা। নতুন বাসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির পরিবহণ মন্ত্রী। অথচ কার্যত তাঁকে এড়িয়েই অনুষ্ঠানে কিছু সময় কাটিয়ে বিমানবন্দরের পথে চলে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মদন। মমতা তাঁকে দেখতে যাননি। কয়েকটি জরুরি কারণে মুখ্যমন্ত্রীকে এসএমএস করেও উত্তর পাননি পরিবহণ মন্ত্রী। বিধ্বস্ত-বিমর্ষ-মুষড়ে পড়া মদন তখন দলে ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে খবরাখবর নিয়ে জেনেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে এড়িয়েই চলতে চাইছেন। সারদা-কাণ্ডে নাম ওঠায় তাঁকে কাছে ঘেঁষতে দিতে চান না। নেত্রীর এই মনোভাব বুঝে মন্ত্রিসভার বৈঠকে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন মদন। একই কারণে মন্ত্রিসভার বৈঠকে যাওয়াা বন্ধ করে দিয়েছিলেন বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ও।
কিন্তু সম্প্রতি দলীয় বৈঠকে নেত্রীর ‘ক্লিনচিট’ পেয়ে এ বার মদনের সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদও খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। প্রায় দু’মাস পর শুক্রবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে মদনের সঙ্গে হাজির ছিলেন শ্যামাপ্রসাদও। এর ২৪ ঘণ্টা না কাটতেই এ দিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি বৈঠকে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, পরিবহণ সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, তথ্য ও সংস্কৃতি সচিব অত্রি ভট্টাচার্য, প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতাদের সঙ্গে উপস্থিত হলেন মদন মিত্রও। নবান্ন সূত্রের খবর, বৈঠকে বেশ কয়েক বার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর উষ্ণ আলাপচারিতা হয়েছে। এমনকী, গরদের পঞ্জাবির উপরে হাল্কা গোলাপি রঙের জওহর কোট পরা মদনকে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বেশ ঝকঝকে দেখাচ্ছে। ওয়েল ড্রেস্ড।’ রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, “আগের অবস্থা কাটিয়ে কিছু দিন ধরেই পরিবহণমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর দূরত্ব কমছিল। এ দিন যা অনেকটাই খোলামেলা।”
শুধু মদন বা শ্যামাপ্রসাদ নয়, গত কাল পুজো পুরস্কারের সময়ে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্নের সঙ্গেও এক মঞ্চে বসেছেন মুখ্যমন্ত্রী। অল্পবিস্তর কথাও বলেছেন। সারদার জেরে শুভাপ্রসন্নের সঙ্গেও তাঁর দূরত্ব বেড়েছিল। একই ভাবে নেত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্যের পর্যায় পেরিয়ে আবার তাঁর পছন্দের মানুষের বৃত্তে ঢুকে পড়েছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে, গাড়িতে আবার তাঁকে দেখা যাচ্ছে ঘন ঘন।
এ সব দেখে শাসক দলের একাংশের ব্যাখ্যা, সারদা তদন্তের গতিপ্রকৃতি যতই এগোচ্ছে, যত তদন্তের জাল গুটিয়ে আসছে, ততই মুখ্যমন্ত্রী ওই সব অভিযোগ নস্যাৎ করার তাগিদ অনুভব করছেন। এটা তারই একটা প্রতিফলন।
তবে অন্য একটি অংশের বক্তব্য, আসন্ন পুরভোট মুখ্যমন্ত্রীর সামনে সবচেয়ে বড় বালাই। বিজেপি-র কড়া চ্যালেঞ্জ সামলে পুরভোটের বৈতরণী পেরোতে হলে মুকুল রায় কিংবা মদন মিত্রের মতো দক্ষ সংগঠকদের প্রয়োজন। এই বাস্তবতাটা বুঝেই মুকুল, মদনদের ফের নিজের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ঢুকিয়ে নিয়েছেন নেত্রী। দলের এক শীর্ষ নেতার মতে, “পঞ্চায়েতে অধিকাংশ আসনে মুকুলের পছন্দের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। এ সব এক দিনে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। নস্যাৎও করা যায় না।” ওই নেতার আরও দাবি, “দলের বেশ কয়েকটি গণসংগঠন, বিশেষত শ্রমিক সংগঠনগুলির মধ্যে মদন মিত্রের প্রভাব সকলেরই জানা। তাঁকে লাগাতার কোণঠাসা করলে দলের অন্দরে যে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, তা ভালই বোঝেন মমতা। তাই আপাতত সারদা পিছনে চলে গিয়েছে।”
তবে এ সব কারণ উড়িয়ে দিচ্ছেন আবার দলের আর এক অংশ। ওই নেতাদের বক্তব্য, “মমতাকে যাঁরা ঘনিষ্ঠ ভাবে চেনেন, তাঁরা জানেন, এ সব কোনও কারণই নয়। এর মধ্যে ক্ষমতাবৃদ্ধি বা কমার কোনও যোগাযোগ নেই। এ হল একেবারেই প্রয়োজনভিত্তিক ডাকাডাকি।”