মেহমান-তরজায় মোদীকে আক্রমণ মুখ্যমন্ত্রীর

ভিন্ রাজ্য থেকে আসা মানুষকে বলেছিলেন ‘মেহমান’। সপ্তাহতিনেক আগে। সেই মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তোলায় এ বার ভিন্ রাজ্যের এক মুখ্যমন্ত্রীকে বললেন ‘হরিদাস’! ‘ভয়ঙ্কর লোক’ এবং ‘শয়তান’ বিশেষণও বাদ গেল না! প্রশ্নকর্তার নাম নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী। জবাবে পাল্টা আক্রমণকারীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! সারদা-কাণ্ড নিয়ে চাঁছাছোলা আক্রমণ করে ২৪ ঘণ্টা আগেই রাজ্যে নির্বাচনী লড়াইয়ের পারদ চড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩৪
Share:

সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার নবান্নে। ছবি: সুদীপ আচার্য

ভিন্ রাজ্য থেকে আসা মানুষকে বলেছিলেন ‘মেহমান’। সপ্তাহতিনেক আগে। সেই মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তোলায় এ বার ভিন্ রাজ্যের এক মুখ্যমন্ত্রীকে বললেন ‘হরিদাস’! ‘ভয়ঙ্কর লোক’ এবং ‘শয়তান’ বিশেষণও বাদ গেল না!

Advertisement

প্রশ্নকর্তার নাম নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী। জবাবে পাল্টা আক্রমণকারীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!

সারদা-কাণ্ড নিয়ে চাঁছাছোলা আক্রমণ করে ২৪ ঘণ্টা আগেই রাজ্যে নির্বাচনী লড়াইয়ের পারদ চড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। এ বার মোদীকে ব্যক্তিগত স্তরে ঝাঁঝালো পাল্টা আক্রমণ করে তাতে নতুন মাত্রা জুড়লেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তবে এই আক্রমণের উপলক্ষ সারদা নয়। বিষোদগারের কেন্দ্রে ভিন্ রাজ্যের বাসিন্দা ও বাংলাদেশি সংক্রান্ত মোদীর মন্তব্য।

Advertisement

মোদী পশ্চিমবঙ্গে ভিন্ন ভাষাভাষী এবং ধর্মীয় সংগঠনের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে সংঘর্ষ বাধাতে চাইছেন বলে অভিযোগ করে এ দিন নবান্ন চত্বরে মমতা বলেছেন, “বাঙালি-অবাঙালি ভাগ করে দিচ্ছে। এত বড় সাহস? এত বড় বুকের পাটা! কে তুই! কে ভাই! কোন হরিদাস?” মোদীকে মমতার হুঁশিয়ারি, “বাংলায় জাতপাতের রাজনীতি আনার চেষ্টা করবেন না! রাজনীতি করছেন করুন, কিন্তু এই ধরনের কথাবার্তা কেন? কোনও ইতিহাস জানে না!”

মোদীর কোন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে মমতার এ হেন আক্রমণ?

শ্রীরামপুরের স্টেডিয়াম মাঠে রবিবার সন্ধ্যায় এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে মোদী বলেছিলেন, “মমতাজি ভোটব্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে এই রাজ্যে রাজনীতি শুরু করেছেন। বিহার, ওড়িশা থেকে এই রাজ্যে গরিব মানুষ কাজে এলে ওঁর রাগ হয়। তাঁদের পর মনে হয়। হেনস্থা হন তাঁরা। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে সীমান্ত পেরিয়ে কেউ এলে উনি তাঁদের ‘আদর’ করে এই রাজ্যে রেখে দেন। ১৯৪৭ সালের পরে যাঁরা ভারতে এসেছেন, তাঁরা বিছানা-বেডিং বেঁধে রাখুন! ১৬ মে-র পরে তাঁদের বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে।”

তার প্রতিক্রিয়ায় এ দিন নবান্নের সামনে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “দেশে কালো দিন টেনে আনা হচ্ছে। কাউকে কাউকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ভাবা হচ্ছে। যিনি দেশের ইতিহাস জানেন না, ভূগোল জানেন না! তিনি বলছেন, বাংলাদেশীদের বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে ফিরে যেতে হবে। এমন অধিকার ওঁকে কে দিয়েছে?”

তৃণমূল নেত্রীর এমন মন্তব্যের আবার তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে বিজেপি-র তরফে। পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে মোদীর মন্তব্যের কিছু ব্যাখ্যাও। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কথায়, “বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থী আর অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে ফারাক আছে। আমাদের এই অবস্থান বহু দিনের। শরণার্থীদের জন্য কিছুই বলেননি মোদী। তিনি বলেছেন অনুপ্রবেশকারীদের ব্যাপারে।” সম্প্রতি অসমে গিয়ে মোদী এ ব্যাপারে আরও স্পষ্ট করে তাঁর মত জানিয়েছিলেন বলেও রাহুলবাবু উল্লেখ করেছেন। বিজেপি-র অভিযোগ, মোদীর কথাকে হাতিয়ার করে পূর্ববঙ্গের মানুষজনের ভাবাবেগ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তৃণমূল নেত্রী। কিন্তু মোদী আদৌ ও’পার বাংলা থেকে সব মানুষকে এক করে কিছু বলেননি বলে তাদের দাবি।

মমতা অবশ্য মোদীর বিরুদ্ধে তোপ দেগে বলেছেন, “প্রথম দিন বলল, দার্জিলিং ভাগ করে দাও। এ বার বাঙালিদের, বাংলাকে ভাগ করার কথা বলছে। হিন্দু-মুসলমান ভাগ করতে চাইছে। বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। দেশের লোককে যে ভালবাসতে পারে না, সে দেশের নেতৃত্ব দেবে?” মোদীকে হুঁশিয়ারি দিয়ে মমতা বলেন, “দাঙ্গা লাগানো থেকে বিরত থাকা উচিত। তিনি বলেন, “দার্জিলিঙের ভাইবোনেরা এ বার ওঁর বাক্সপ্যাঁটরা গুটিয়ে ওঁকে বুঝিয়ে দেবেন!”

কিন্তু মোদী শ্রীরামপুরের সভায় ওই কথা বললেন কেন?

রাজ্য বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, গত ৪ এপ্রিল তৃণমূল নেত্রী কুলটির জনসভায় বিহার, উত্তরপ্রদেশ-সহ অন্য রাজ্য থেকে যে সব মানুষ এখানে আসেন, তাঁদের ‘মেহমান’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ওই সভায় মমতা বলেছিলেন, “উত্তরপ্রদেশ, বিহার থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা আমাদের মেহমান। তাঁদের দেখতে হবে, ভাল ভাবে রাখতে হবে।”

বিজেপি-র মুখপাত্র সিদ্ধার্থনাথ সিংহ আসানসোলে সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। সিদ্ধার্থনাথ ওই দিন বলেছিলেন, “এখানে ভিন্ রাজ্যের প্রচুর পরিবার বংশ পরম্পরায় বাস করছেন, সৌভ্রাতৃত্বের সঙ্গে রয়েছেন। তাঁরা হঠাৎ মেহমান কেন হয়ে যাবেন?” রাজ্য বিজেপি ওই বক্তব্যকে আপত্তিকর বলে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগও দায়ের করেছিল। মমতার ওই মন্তব্যের প্রেক্ষিতেই রবিবার শ্রীরামপুরের সভায় মোদী ওই মন্তব্য করেন বলে রাজ্য বিজেপি-র অভিমত। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুলবাবু এ দিনও বলেছেন, “নিজেদের রাজ্যের পাট চুকিয়ে অনেক মানুষ এ রাজ্যেই রয়েছেন অনেক বছর ধরে। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাঁরাও সামিল। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে তাঁদের অনেকেই খুব আঘাত পেয়েছেন বলে আমাদের জানিয়েছিলেন। মোদী সেই কথাই বলেছেন।” রাহুলবাবুর আরও দাবি, “তার জবাব দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীই এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিভাজন তিনিই করছেন!”

এ রাজ্যে বাঙালিদের সঙ্গে অন্য ভাষাভাষীদের যে কোনও বিরোধ নেই, তা বোঝাতে মমতা এ দিন বলেন, “প্রেসিডেন্সির প্রধান পদে অনুরাধা লোহিয়াকে বসানো হয়েছে। তিনি এক জন মাড়োয়ারি মহিলা। রাজ্যের ডিজি অন্ধপ্রদেশের মানুষ। অনেক আধিকারিক আছেন, যাঁরা অন্য রাজ্যের। তাঁরা ভাল কাজ করছেন। আমার গাড়ির চালকও বিহারী। তাতে কী হয়েছে!” অ-বাংলা ভাষাভাষীদের দিকে তাঁর সরকার কী ভাবে নজর দিচ্ছে, তা বোঝাতে মমতা বলেন, “এখানে ছট পুজোয় ছুটি দেওয়া হচ্ছে। আমি গঙ্গাপুজো করি। সবেবরাতেও যাই।” তাঁর দাবি, গুজরাতে ছট পুজোয় কোনও ছুটি দেওয়া হয় না। ইন্টারনেট ঘেঁটে জানার পরেই তিনি এই দাবি করছেন বলে মমতা জানান। তাঁর মন্তব্য, “বাংলা, হিন্দি, উর্দু কোনও ভাষাতেই কথা বলা অপরাধ নয়।”

প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে ঝগড়া করা উচিত হবে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি, নেহরু-লিয়াকত চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যাঁরা এ দেশে এসেছেন, তাঁরা সবাই ভারতীয় নাগরিক। তার পরেও কেউ বিপদে পড়ে এলে তাঁদের ঠেলে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপুঞ্জের একটা নিয়ম আছে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “কোচবিহারেও অনেক বাংলাদেশি আছেন। তাতে কী হয়েছে! অসমেও গোলমালের পরে অনেকে এ রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে। এটাই মানবিকতার ধর্ম।”

ভিন্ রাজ্য থেকে এসে এ রাজ্যের বাসিন্দাদের কাছে তৃণমূল নেত্রীর আহ্বান, মোদীর কথার প্রতিবাদে তাঁরা জোট বেঁধে বিজেপি-র বিরুদ্ধে ভোট দিন। গরিব মানুষের উন্নয়নে পশ্চিমবঙ্গ গুজরাতের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে বলে দাবি করে সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি মমতার কটাক্ষ, “উনি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসলে দুঃসহ দিন আসবে। অন্ধকূপ হত্যার মতো সারা দেশকে জ্বালিয়ে দেবেন। যে ভাবে গুজরাতে শিশু, গর্ভবতী মহিলাদের জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে!” সঙ্গে আরও সংযোজন, ‘‘তাকানোটাই ভয়ঙ্কর! তাকাচ্ছে আর সব জ্বালিয়ে দিচ্ছে! দাঙ্গারাজের কাছ থেকে আমি কোনও কথা শুনতে চাই না!”

এরই সঙ্গে মমতার প্রশ্ন, নির্বাচনী প্রচারে এত হাজার হাজার কোটি টাকা বিজেপি খরচ করছে কোথা থেকে? তাঁর দাবি, “নির্বাচনে জেতার জন্য এখানে জাতপাতের ব্যবসা করছে। বাঙালিদের মধ্যে বিভেদ ঘটানোর যে কথা তিনি (মোদী) এ রাজ্যে এসে বলে গিয়েছেন, সেটা নির্বাচন কমিশনের দেখা উচিত। কমিশন শুধু তৃণমূলের দোষ দেখে বেড়াচ্ছে!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement