এখন আক্রমণই তাঁর রক্ষণের হাতিয়ার। তাই পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রকে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজেই পথে নেমে পড়লেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিশানা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং একই সঙ্গে সিবিআই-কে! যদিও ক’ঘণ্টার মধ্যেই মমতার তোলা অভিযোগ মাঠের বাইরে ফেলে দিলেন সিবিআই অধিকর্তা অনিল সিন্হা।
সারদা-কাণ্ডে নাজেহাল হয়ে কিছু দিন ধরেই সহারা গোষ্ঠীর অর্থলগ্নি কারবারের সঙ্গে নাম না-করে প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি নেতৃত্বকে জড়িয়ে তির ছুড়তে শুরু করেছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। মদন গ্রেফতার হওয়ার পরে এখন চাপ বহু গুণে বেড়ে গিয়েছে মমতার উপরে। মদনের হয়ে ব্যাট ধরা কঠিন জেনেও বাধ্য হয়েই পাল্টা আক্রমণে যাচ্ছেন তিনি। কারণ তা না হলে চাপের মুখে ভেঙে পড়ার বার্তা চলে যাওয়ার আশঙ্কা!
এই কাজ করতে গিয়েই শনিবার ক্রীড়ামন্ত্রীর গ্রেফতারির প্রতিবাদে ময়দানে গোষ্ঠ পালের মূর্তির সামনে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ ক্রীড়াবিদদের ধর্নায় মুখ্যমন্ত্রী অধুনা জেলবন্দি সহারা-কর্তার সঙ্গে মোদীর ছবি দেখিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, মোদীকে গ্রেফতার করা হবে না কেন? দলকে নির্দেশ দিয়েছেন, এই ছবি নিয়ে সর্বত্র প্রতিবাদে নামতে হবে। সোমবার সংসদ বসলে বিক্ষোভে নামতে হবে দলীয় সাংসদদের। পথে নামার ডাক দিয়েছেন কলকাতার তিন প্রধান ক্লাবের সদস্য-সমর্থকদের। পাশাপাশি, ঘনিষ্ঠ মহলে মমতার ইঙ্গিত, প্রয়োজন হলে দিল্লি গিয়ে ৭, রেসকোর্স রোডে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে তিনি নিজেই ধর্নায় বসবেন! তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, অতীতে প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে কোনও মুখ্যমন্ত্রীর ধর্না দেওয়ার নজির নেই। কিন্তু বিপদে পড়ে বেনজির হতেও পিছপা হবেন না তিনি।
প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপি-কে নিশানা করে এ দিন মমতা অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জন্য সিবিআই-কে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিজেপি-র নির্দেশেই সিবিআই মদনকে গ্রেফতার করেছে। তাঁর কথায়, “বিজেপির ফ্রন্টাল অর্গানাইজেশন হয়ে গিয়েছে সিবিআই। ওই আরএসএস, বজরঙ দলের মতো।”
দিল্লির লোদী রোডের সিবিআই সদর দফতরে বসে শুক্রবার মদনকে গ্রেফতারের নির্দেশ যিনি দিয়েছিলেন, সেই সিবিআই অধিকর্তা অনিল সিন্হা অবশ্য এ দিনই মমতার অভিযোগ উড়িয়ে সাফ বলেছেন, “সিবিআইয়ের তদন্ত কারও ভাল লাগবে, কারও লাগবে না। তা নিয়ে সিবিআই থোড়াই কেয়ার করে! সিবিআইয়ের কাজে কার সুবিধা হচ্ছে, কার অসুবিধা হচ্ছে, তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না!”
সিবিআই অধিকর্তা জানিয়েছেন, কোনও রাজনৈতিক চাপে সারদার তদন্ত চলছে না। নির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই সিবিআই এগোচ্ছে। সংস্থার সেরা ও দক্ষ অফিসারেরাই তদন্ত করছেন। তাঁদের স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন নিরপেক্ষ তদন্ত হয়। অনিলের কথায়, “আমরা শুধু দেখছি, আমাদের দায়িত্ব যেন ভাল ভাবে পালন করতে পারি। যাতে সিবিআই আদালতকে সন্তুষ্ট করতে পারে। খুব শীঘ্রই সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের মুখোশ খুলে দেওয়া হবে!”
দিল্লিতে এ দিন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সারদার তদন্তে কোনও রকম রাজনৈতিক চাপ আসছে কি? অনিলের জবাব, “কেউ আমার সঙ্গে কথা বলেননি। আমিও অন্য কারও হয়ে কথা বলতে পারি না। আমাদের তদন্তের কথা বলতে পারি। আমরা যা করেছি, তদন্তে উঠে আসা তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতেই করেছি। ভবিষ্যতেও আমরা তা-ই করব।” প্রধানমন্ত্রী মোদীও প্রথম থেকেই বলে আসছেন, সিবিআই নিজের মতো তদন্ত করবে। সরকার কাউকে ফাঁসানোর নির্দেশ দেবে না, কাউকে বাঁচাতেও যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর সেই অবস্থানের প্রতিধ্বনিই এ দিন শোনা গিয়েছে সিবিআই অধিকর্তার মুখে।
মমতা অবশ্য এ সবে কর্ণপাত করতে রাজি নন। নিজের ঘর বাঁচাতেই তাঁকে এখন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়াতে হচ্ছে। যে কারণে এ দিন পূর্ব ঘোষণা না থাকলেও মদনের পাশে দাঁড়াতে ক্রীড়াপ্রেমীদের ধর্নায় নিজেই চলে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে বলেছেন, “সিবিআই থাকার প্রয়োজন নেই। আমরা উচ্চ আদালতে জানতে চাইব, সিবিআই তার সীমা লঙ্ঘন করছে না তো? রাজনৈতিক দলের নির্দেশে কেন কাজ করবে? লেট দেম ড্রপ!” বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন যে মমতা যে কোনও বিষয়ে সিবিআই তদন্ত দাবি করতেন, সেই তিনিই এ দিন বলেন, “আগে সিবিআই শুনলে লোকে ভয় পেত। এখন পাচ্ছে না। ঘরের ভাত খেত, এখন জেলের ভাত খাবে! দু’দিন বাদে বেরিয়ে আসবে!”
সহারার তথাকথিত লাল ডায়েরির প্রসঙ্গ এ দিনও তুলেছেন মমতা। বলেছেন, “সহারার ওই লাল ডায়েরিতে কার কার নাম আছে জানলে, সকলে শিউরে উঠবেন! শূন্য কলসি বড্ড বাজে বেশি!” তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, সহারার অর্থলগ্নি সংস্থার দফতরে তল্লাশি করে নাকি একটি ‘লাল ডায়েরি’ পাওয়া গিয়েছে! সেই ‘কাল্পনিক ডায়েরি’ নিয়েই এখনও লড়ে যাচ্ছেন মমতা!
সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে মদনের ছবি তদন্তকারীদের হাতে আছে। মমতা এ দিন পাল্টা বলেছেন, “সহারা-কর্তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ছবি রয়েছে। তা হলে তাঁকে কেন গ্রেফতার করা হবে না? আইন তো সবার জন্যে সমান!’’ তাঁর কথা শেষ হতে না হতে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস সহারা-কর্তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ছবি দেখান মুখ্যমন্ত্রীকে। সঙ্গে সঙ্গে সোল্লাসে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর অনুগামীদের বলেন, “লাগাও ছবি! ১০ লক্ষ ছবি দিয়ে পোস্টার হবে!”
তার পরেই তাঁর নির্দেশ, “এই ছবি আমাদের দলের সাংসদদের দাও। ওঁরা সোমবার সংসদে এই ছবি নিয়ে যাবেন।’’ মোদী এবং সহারা-কর্তার ছবির প্রসঙ্গে রাজ্য বিজেপি-র সম্পাদক রীতেশ তিওয়ারি কটাক্ষ করেন, “১০ মিনিট সময় পেলে আমিও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সহারা-কর্তার ছবি দেখাতে পারি! মুখ্যমন্ত্রী ওই ছবি দেখিয়ে মানুষকে বোকা বানাতে পারবেন না।”
তবে মমতা ঠিক করে ফেলেছেন, শুধু সংসদ নয়, তিনি দলের নেতাদের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে ধর্নায় বসার নির্দেশ দিতে পারেন। তেমন প্রয়োজন হলে তিনি নিজেও সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে মুখ্যমন্ত্রী ধর্নায় বসলে নিঃসন্দেহে তা অভিনব ঘটনা হবে!
শুক্রবারের মতো এ দিনও মদনের পাশে দাঁড়িয়ে মমতা বলেছেন, “মদন চোর, এটা আমি বিশ্বাস করতে রাজি নই!... যদি বলেন, কোনও ক্লাবের জন্য কাউকে বলেছে পাঁচ লক্ষ টাকা দিন, আমি বিশ্বাস করব। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না মদনের এত কিছু অভাব হয়েছে যে, সারদার টাকায় ও বউ-বাচ্চাকে খাওয়াবে!’’
একই সঙ্গে বিজেপি নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “আমারা এখানে ক্ষমতায় রয়েছি। আপনাদের নেতারা এসে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে! ভদ্রতা করেছি, কিছু করিনি। দাঙ্গার জন্য এক সেকেন্ডে গ্রেফতার করা যায়! দেখবেন মজা? আপনার হাতে আইন আছে, আমার হাতে নেই? দেখবেন? পরখ করবেন?”
বিজেপি-র প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথাগত রায় যার জবাবে বলেছেন, “আমাদের দলকে যিনি দাঙ্গাবাজ বলছেন, তিনিই তিন দাঙ্গাবাজকে নিজের পক্ষপুটে আশ্রয় দিয়েছেন! ইদ্রিশ আলি, হাজি নুরুল এবং আহমেদ হাসান ইমরান। এর পর আমাদের দাঙ্গাবাজ বলতে ওঁর লজ্জা করে না?”