সেল-বন্দি ২

মুঠোয় ‘চকোলেট-চিপস’ এলে কাজ হাসিল কারাগার থেকেই

কোথাও ‘চকোলেট’, কোথাও ‘চিপস’। আবার কোথাও ‘মুঠঠি’ বা ‘মুঠো’। সংশোধনাগারের অন্দরে মোবাইলের হরেক নাম। নানা সময়ে সংশোধনাগার ঘুরে আসা বন্দিদের কাছ থেকে মোবাইলের এই সব সাঙ্কেতিক নাম জেনেছেন অনেকেই। পুলিশ ও কারা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, মূলত চারটি উপায়ে জেলের মধ্যে ‘চকোলেট-চিপস-মুঠঠি’ পৌঁছে যায়।

Advertisement

কিশোর সাহা

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৪ ০২:৩১
Share:

কোথাও ‘চকোলেট’, কোথাও ‘চিপস’। আবার কোথাও ‘মুঠঠি’ বা ‘মুঠো’। সংশোধনাগারের অন্দরে মোবাইলের হরেক নাম। নানা সময়ে সংশোধনাগার ঘুরে আসা বন্দিদের কাছ থেকে মোবাইলের এই সব সাঙ্কেতিক নাম জেনেছেন অনেকেই।

Advertisement

পুলিশ ও কারা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, মূলত চারটি উপায়ে জেলের মধ্যে ‘চকোলেট-চিপস-মুঠঠি’ পৌঁছে যায়। সব মিলিয়ে ওই চারটি পদ্ধতি সম্পর্কে পুলিশ এবং কারা বিভাগ যা জানতে পেরেছে তা হল

১) কারারক্ষীদের একাংশ বাইরে থেকে মোবাইল হ্যান্ডসেট জোগাড় করে বন্দিদের ভাড়া দিয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে বন্দিকে ভুয়ো নামে সিম-কার্ড জোগাড় করাতে হয়। এক-এক দিন মোবাইল হ্যান্ডসেটের ভাড়া ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। যে সব বন্দিদের আর্থিক ক্ষমতা কম, তাঁদের ৩ মিনিটের কলের জন্য মোবাইলের ‘মালিক’কে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।

Advertisement

২) সংশোধনাগার থেকে আদালতে যাতায়াতের পথে বা প্রিজন ভ্যানে ওঠানো-নামানোর সময়ে যে কৌশলে বন্দিদের একাংশ নানা নেশার জিনিস জোগাড় করে, সেই পথেই মোবাইলও ঢোকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বন্দিরা অন্তর্বাসের মধ্যে মোবাইল সেট লুকিয়ে পাহারাদারদের নজরদারি এড়ানোর চেষ্টা করে। অনেক সময়ে বিস্কুটের প্যাকেটে ছোট্ট মোবাইল ঢুকিয়ে তা ‘সিল’ করিয়ে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়। রক্ষীদের সঙ্গে ‘ঠিকঠাক বোঝাপড়া’ থাকলে ওয়ার্ড বা সেল পর্যন্ত মোবাইল নিয়ে যেতে সমস্যা হয় না।

৩) প্রভাবশালী রাজনৈতিক বন্দিদের কাছে মোবাইল পৌঁছনোর জন্য নানা মহল সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাঁদের বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার ব্যবস্থা করাতে সেই সব মহলই যাবতীয় বন্দোবস্ত করে দেয় বলে অভিযোগ। বাম আমলেও এমন অভিযোগ প্রশাসনের কাছে ছিল। এখন তৃণমূল জমানাতেও তার অন্যথা হচ্ছে না।

৪) অপরাধ জগতের প্রথম সারির অভিযুক্ত, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রাখা অপরাধীরা অন্ধকার জগতের নিজস্ব ‘নেটওয়ার্ক’ ব্যবহার করে মোবাইল জোগাড় করে নেয়।

সরকারি তরফে অবশ্য এই ‘তত্ত্ব’ কোনও কর্তাই মানতে রাজি নন। প্রকাশ্যে কেউ মুখও খুলবেন না। কিন্তু, পুলিশ ও কারা দফতরের অফিসার-কর্মীদের একাংশ ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আলোচনায় মানছেন, ফি মাসে শুধু মোবাইল, সিম-কার্ডের লেনদেনের জন্য বন্দিদের একাংশ ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ করতে পরোয়া করে না। ওই টাকা তাদের আত্মীয়-স্বজন কিংবা দলের লোকজন নানা কায়দায় ‘গন্তব্যে’ পৌঁছে দেয়।

কিন্তু, মোটা টাকা দিয়ে সংশোধনাগারে মোবাইল এনে বন্দিরা করে কী?

পুলিশ ও সিআইডি সূত্রের খবর, সংশোধনাগারে বসেই উত্তরপ্রদেশের মাফিয়া ডন বাবলু শ্রীবাস্তব মোবাইলে নির্ভর করে যে ভাবে দল চালাত, সেই কায়দায় এ রাজ্যেও মোবাইল ব্যবহার করে কাজ হাসিল করে একাধিক অপরাধী। অতীতে শিলিগুড়ি জেলে বসে বিদেশে মোবাইলে যোগাযোগ রেখে বহাল তবিয়তে বিদেশি পণ্যের চোরাচালান চালানোর ঘটনাও পুলিশের নথিতে রয়েছে।

মেদিনীপুর সংশোধনাগারে বসে মাওবাদীদের একাংশ মোবাইলের সাহায্যে মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে নানা খবরাখবর আদানপ্রদান শুধু নয়, দলের রসদ সংগ্রহের বন্দোবস্ত করেছেন বলেও পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের সন্দেহ। আত্মসমর্পণকারী কেএলও জঙ্গিদের একাংশ আবার পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, মোবাইল থাকলে জেলে বসে হুমকি দিয়ে ২-৫ লক্ষ টাকা আদায় করা তাঁদের কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। একাধিক জঙ্গি, বড় মাপের দুষ্কৃতীকেও জেলে বসে ওই কায়দায় ভয় দেখিয়ে তোলা আদায় করতে দেখেছেন বলেও দাবি করেছেন তাঁরা।

প্রায় দেড় দশক ধরে সংশোধনাগার থেকে মোবাইলে দল চালানো, টাকা আদায়, খুনোখুনির ট্র্যাডিশন চলছে এ রাজ্যে। মাঝেমধ্যে কয়েকশো মোবাইল, সিম-কার্ড বাজেয়াপ্ত হলেও সমস্যা মেটে না। তা হলে সংশোধনাগারের চার দেওয়ালের ভিতর থেকে এই অবাধ যোগাযোগ রোখার উপায়টা কী? এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান কী ভাবে হবে, যা ভাবাচ্ছে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও?

(চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement