ধূপগুড়ি-কাণ্ড নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলাদলির মধ্যে পড়তে চান না নিহত ছাত্রীর বাবা-মা। তাই তাঁরা এখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করবেন না। বুধবার নিহত ছাত্রীর মামাবাড়িতে বসে তাঁর বাবা-মা একযোগে এ কথা জানিয়েছেন। এ দিন তৃণমূলের জলপাইগুড়ি জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী ধূপগুড়িতে গিয়ে চেষ্টা করেও নিহত ছাত্রীর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি।
নিহত ছাত্রীর বাবা-মায়ের বক্তব্য, তাঁদের মেয়েকে তৃণমূল নেতাদের ডাকা সালিশি সভায় নিগ্রহ করা হয়। তার পরে মেয়েকে গণধর্ষণ ও খুন করা হয়েছে বলে তাঁদের সন্দেহ। অথচ সৌরভবাবু গোড়াতেই ঘটনাটি ‘আত্মহত্যা’ বলে মন্তব্য করেন। ওই দম্পতি বলেন, “এই মন্তব্যের ফলে পুলিশের তদন্ত প্রভাবিত হয়েছে। তাই আমরা পুলিশের তদন্তে আস্থা রাখতে না পেরে সিবিআই তদন্তের দাবিতে উচ্চ আদালতে আবেদন করেছি। এখন যা হবে আইনি পথেই হবে।”
মঙ্গলবার ধূপগুড়িতে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব ওই নিহত ছাত্রীর বাড়িতে গিয়ে তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তাঁরা তখন বলেছিলেন, ভেবে দেখবেন। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছেন কেন? তাঁরা বলেন, “আমরা মেয়ের মৃত্যু নিয়ে কাউকে রাজনীতি করতে দেব না। দলাদলির মধ্যে যাব না। সে জন্য এখন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব না।”
সৌরভবাবুর সঙ্গে দেখা করলেন না কেন? নিহত ছাত্রীর বাবা জানান, তাঁরা ‘একটা কাজে’ বাড়ির বাইরে ছিলেন। তবে দেখা করায় তাঁরা আগ্রহী নন, তা-ও বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “ঘটনার পরে তৃণমূলের যে নেতার উদ্যোগে ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে দাবি জানিয়ে ধিক্কার মিছিল হয়েছে, তিনি এখন আমাদের নিয়ে এত ভাবছেন কেন? দেখা করে কী হবে? আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে নেতারা দলের ভাবমূর্তি ঠিক করার চেষ্টা করবেন। কিছু ভাল ভাল কথা শোনা যাবে। কিন্তু, দোষীরা কেন গ্রেফতার হচ্ছে না সেই প্রশ্নের জবাব মিলবে না।” সৌরভবাবু অবশ্য জানান, এ দিন দেখা না হলেও, তাঁরা ওই পরিবারের পাশেই রয়েছেন।
এখন তৃণমূলের নানা নেতা ওই পরিবারকে সুবিচারের আশ্বাস দিলেও, গত ২ সেপ্টেম্বর ওই ছাত্রীর দেহ মেলার পর থেকে দলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এলাকার বাসিন্দাদের অনেকে। ওই ছাত্রীর মৃত্যুর আগের দিন সন্ধ্যায় যে সালিশি সভা হয়েছিল, তার উদ্যোক্তা ছিলেন ধূপগুড়ি পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর নমিতা রায়ের স্বামী চন্দ্রকান্তবাবু। সেখানে ছাত্রীটির বাবাকে পাওয়ার টিলারের বকেয়া ভাড়া সময়ে দিতে না-পারায় মোটা টাকা জরিমানা করা হয়। ওই মেয়েটি প্রতিবাদ করলে তাকে চুলের মুঠি ধরে মারধর করেন তৃণমূলের স্থানীয় এক নেতার স্ত্রী প্রতিমা বর্মন। এর পরে ছাত্রীটিকে থুতু চাটার ফতোয়া দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। ওই সময়ে ছাত্রীটি বাড়ির দিকে ছুটে যায়। রাতে তার হদিস মেলেনি। পরদিন তার বিবস্ত্র দেহ মেলে রেললাইনে।
ওই ঘটনার পরে নিহতের পরিবার গণধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ করলেও তা জমা নেওয়া নিয়ে ধূপগুড়ি থানা ও ধূপগুড়ি স্টেশনের রেল পুলিশ দিনভর চাপানউতোর চালায়। সন্ধ্যায় অভিযোগ নেয় রেল পুলিশ। কিন্তু দেহ মেলার পর থেকেই ওই মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন তৃণমূল নেতারা। এমনকী, বিরোধীরা আত্মহত্যার ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করছে, এই অভিযোগে একটি ‘ধিক্কার মিছিল’-ও বার করে জেলা তৃণমূল। তদন্তে বাধা দেওয়ার অভিযোগও ওঠে। ঘটনায় অভিযুক্ত তৃণমূল নেতাদের অনেকে এখনও অধরা।
এ দিকে রেল পুলিশ মামলার তদন্তের ভার ধূপগুড়ি থানার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যেই রেল পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিকবার জলপাইগুড়ি আদালতে সেই আর্জি জানানো হয়েছে। তৃণমূলের অন্দরের খবর, সিবিআই তদন্তের আর্জিতে যে আবেদন হয়েছে, তার শুনানির সময়ে রাজ্যের ভূমিকা নিয়ে উচ্চ আদালতে অনেক প্রশ্ন হতে পারে। ইতিমধ্যে কলকাতার বামমনস্ক বিদ্বজ্জনদের একটি দল ছাত্রীর বাবাকে কলকাতা হাইকোর্টে আবেদনের পরামর্শ দেন। তাঁদের সহায়তায় হাইকোর্টে সিবিআই তদন্তের দাবিতে আবেদন করেন ছাত্রীর বাবা।
ধূপগুড়ি কাণ্ড নিয়ে দলের ভূমিকায় ক্ষোভ ক্রমশ তীব্র হওয়ায়, দলের কিছু নেতা দলের অবস্থান পাল্টানোর চেষ্টা করেন। কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্না ধূপগুড়িতে একটি সভায় বলেন, “আমরা যতদূর শুনেছি মেয়েটিকে গণধর্ষণের পরে খুন করা হয়েছে।”