পুলিশের হা-রে-রে-রে চিৎকার, ভ্যানের গায়ে ধাঁই ধপাধপ চাপড় সব জলে গেল। মঙ্গলবার শিয়ালদহ কোর্টের বাইরে আইনরক্ষকদের যাবতীয় কৌশলে চোনা ফেলে দিয়ে বাক্য-বোমা ফাটালেন আসিফ খান।
পুলিশের ‘হল্লাবাহিনী’র ক্ষণিক বিভ্রান্তি ও নীরবতার সুযোগে নিয়ে সারদা-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় ও পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রকে জড়িয়ে এ দিন ফের প্রকাশ্যে কটাক্ষ করেছেন আসিফ। পুলিশি ঘেরাটোপের মধ্যে দাঁড়িয়েই মুকুলবাবুর ওই একদা ছায়াসঙ্গী যা বলার বলে দিয়েছেন। তাতে শাসকদলের বিড়ম্বনা যেমন বেড়েছে, তেমন অস্বস্তিতে পড়েছেন পুলিশ-কর্তারাও। প্রসঙ্গত, সংবাদ মাধ্যমের সামনে কুণাল ঘোষ বা আসিফ খানের মন্তব্যের তির রুখতে না-পারায় কিছু পুলিশ-কর্তা ইতিমধ্যে প্রশাসনের উপরমহলের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছেন বলে পুলিশ-সূত্রে ইঙ্গিত মিলেছে।
তৃণমূলের সাসপেন্ড হওয়া সাংসদ কুণাল ঘোষও সারদা-কাণ্ডে জেলে ঢুকে শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্বের দিকে অনবরত তোপ দেগে যাচ্ছেন। তাঁর কথা যাতে সংবাদ মাধ্যমের কান পর্যন্ত না-পৌঁছয়, সে জন্য পুলিশ-প্রশাসনের তৎপরতাও দেখার মতো। কুণালের বাক্যবাণ চাপা দিতে পুলিশ বর্গিদের মতো হা-রে-রে-রে রব তুলেছে। পাশাপাশি ‘রুদালি’র (মড়াকান্না বিশারদ পেশাদার কাঁদুনের দল) মতো সমস্বরে ‘হায় হায়’ ধ্বনিতেও কোর্ট চত্বর মাত করেছে। কুণালকে এ ভাবে ‘শব্দাস্ত্রে’ জব্দ করার তাগিদে বিভিন্ন থানা থেকে বাছাই করা পুলিশকর্মীদের বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে আনা হয়েছে, যাঁরা কিনা মুখ চালানোর সঙ্গে সঙ্গে ভ্যানের গায়ে ধপাধপ চাপড় মেরেও শোরগোলের ডেসিবেল বাড়াচ্ছেন।
কিন্তু সে সব কার্যত বিফলে গিয়েছে। এত আয়োজনের মাঝেও কুণাল ফাঁক পেলেই সংবাদ মাধ্যমের সামনে মুখ্যমন্ত্রী-সহ তৃণমূল নেতাদের জড়িয়ে বিবিধ ‘বিস্ফোরক’ মন্তব্য করে গিয়েছেন। শেষমেশ গত ১ ডিসেম্বর ব্যাঙ্কশাল কোর্টের বাইরে কুণালের কণ্ঠরোধ করতে পুলিশ কুস্তিগিরের মতো গলা দাবিয়ে ধরে তাঁকে গাড়িতে তোলে। আসিফের উপরে এখনও তেমন বাহুবল প্রয়োগ না-হলেও ক’দিন আগে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে ‘ডাকাতরানি’ বিশেষণে ভূষিত করা ইস্তক হল্লা-পুলিশ এনে তাঁর কণ্ঠ চাপা দেওয়ার যাবতীয় চেষ্টা চলেছে।
এবং এ দিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আসিফকে নিয়ে পুলিশের গাড়ি সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ শিয়ালদহ আদালতে ঢোকা মাত্র এন্টালি থানার পুলিশ জায়গাটা ঘিরে ফেলেছিল। গাড়ি থেকে আসিফকে নামানোর আগেই তিনি মুখ খোলেন। বলে ওঠেন, “আমি যে দিন বার হব (জেল থেকে), সে দিন বাকিরা ঢুকবে। আমাকে যারা ঢুকিয়েছে, তারা সে দিন ঢুকবে।” সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ হা-রে-রে-রে শুরু করে দেয়। পরিস্থিতি বুঝে আসিফও তখন আর কিছু বলার চেষ্টা করেননি।
সেই চেষ্টা তিনি করলেন বিকেলে, আদালত থেকে বেরনোর পথে। সফলও হলেন। কী ভাবে?
বিকেল চারটে নাগাদ আসিফকে যখন আদালত থেকে বার করা হচ্ছিল, পুলিশ কিন্তু পুরোমাত্রায় সতর্ক ছিল। কোনও ঝুঁকি না-নিয়ে আগেভাগেই তারা হা-রে-রে-রে জুড়ে দেয়। সঙ্গে চলে সমান তালে গাড়ি পেটানো। আসিফ নির্বিবাদে পুলিশ ভ্যানে ঢুকে যান। কিন্তু দেখা যায়, গাড়িতে চালক নেই! কয়েক জন পুলিশকর্মী চালককে খুঁজতে ছোটেন। কেউ ছোটেন কর্তাদের খবর দিতে। ডামাডোলের মধ্যে পড়ে হল্লাবাহিনী খানিকটা হতভম্ব হয়ে চুপ করে যায়। আর সেই সুযোগে ভ্যানের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আসিফ বলেন, “মদন এখনই জেলে ঢুকবে। আমি বেরোলে মুকুল ঢুকবে। তার পরেই মমতা।”
সঙ্গে সঙ্গে আবার হা-রে-রে-রে, ধাঁই-ধপাধপ। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার, হয়ে গিয়েছে! যা বলতে চেয়েছিলেন, তা উগরে দিয়েছেন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা।
আদালতের লক-আপের ভিতরে এ দিন আসিফ চুপচাপই ছিলেন। দুপুর তিনটে নাগাদ শিয়ালদহের এসিজেএম আদালতের বিচারক অর্পিতা ঘোষের এজলাসে বেনিয়াপুকুর থানার এক মামলায় তাঁর কৌঁসুলি মক্কেলের জামিনের আর্জি জানান। আসিফের বাড়িতে তল্লাশিতে বাধাদানের অভিযোগে পুলিশই মামলাটি দায়ের করেছে। এই মামলায় বিচারক এ দিন আসিফের জামিন মঞ্জুর করেছে। তবে এখনই তিনি জেল থেকে বার হতে পারছেন না। কারণ, প্রতারণার মামলায় এখনও জামিন মেলেনি।
আসিফের কৌঁসুলি লোকেশ শর্মা এ দিন বলেন, “বেনিয়াপুকুরের মামলাটা ভুয়ো ছিল। সব ক’টাই মিথ্যে মামলা। সব ক’টায় আমরা জিতব।”