তৃণমূলের মহিলা উপ-প্রধান সোজাসাপটা বলে দিলেন, “জঙ্গলমহল মোটেই হাসছে না, বরং কাঁদছে, বুঝলেন, কাঁদছে!”
বক্তা বিমলা সরেনের বাড়ি লালগড়ের শালডিহা গ্রামে। তরুণী, দুই সন্তানের মা বিমলা সিজুয়া বা কাঁটাপাহাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান। যে তল্লাট ছ’বছর আগের সেই উত্তাল আন্দোলনের ধাত্রীভূমি। যে আন্দোলনের অব্যবহিত কারণ ছিল আদিবাসী মহিলাদের উপরে পুলিশি অত্যাচার। তখন পঞ্চায়েতের ক্ষমতায় ছিল ঝাড়খণ্ড পার্টি আর শাসন কার্যত ছিল মাওবাদীদের। পরিবর্তনের হাওয়া গতিপথ বদল না করায় বছর দেড়েক আগে পঞ্চায়েত ভোটে বিপুল ভাবে জিতে তৃণমূলই সিজুয়ার ক্ষমতায়। প্রধান, উপ-প্রধান দু’জনই তৃণমূলের, দু’জনই আদিবাসী, দু’জনই মহিলা।
কিন্তু পঞ্চায়েতে বসার দেড় বছর কাটতে না কাটতেই খোদ তৃণমূল উপ-প্রধানের বিস্ফোরক উক্তি। লালগড় আন্দোলনের ছ’বছর পূর্তির মুখে। কাকতালীয় হলেও ঘটনা যে, আন্দোলন শুরুর দিন, ২০০৮-এর ৬ নভেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার। আর এ বছর ৬ নভেম্বরও সেই বৃহস্পতিবার। দিন-বার মিলে গেলেও পরিস্থিতির মিল নেই। পুলিশ বা আধা সামরিক বাহিনীর হাতে নারীর অসম্মান নেই, পুলিশি সন্ত্রাস নেই, মাওবাদীদের দাপট নেই, কথায় কথায় শিউরে ওঠা নেই।
কিন্তু লালগড় তথা জঙ্গলমহলের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা কি এই ছ’বছরে আদৌ পাল্টেছে? শুধু তো রাষ্ট্রশক্তির অত্যাচার ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে নয়, আন্দোলন ছিল বঞ্চনা ও অবহেলার বিরুদ্ধে এবং প্রাপ্য ও অধিকার বুঝে নেওয়ার লক্ষ্যেও। অথচ কাঁটাপাহাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ-প্রধানের নিজের গ্রাম ও লাগোয়া গাড়রা গ্রামে গিয়ে মনে হল না, সেই বঞ্চনার অবসান আদৌ হয়েছে।
জঙ্গল লাগোয়া নয়, একেবারে জঙ্গলের মধ্যেই অবস্থিত এই দু’টি গ্রামে রাস্তার হাল খারাপ বললে ভুল হবে, রাস্তার অস্তিত্বই নেই। শেষ বার মোরাম পড়েছিল ২০০৯-এ। বিদ্যুতের খুঁটি আছে, কিন্তু বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। অথচ পানমণি মাণ্ডি, বরেন সরেন, বিজয় সরেনদের কারও নামে ১৪৫ টাকা, কারও নামে ১২০ টাকার বিল চলে এসেছে। পানীয় জলের কোনও সরকারি বন্দোবস্ত নেই। সেচের ব্যবস্থা নেই। ১০০ দিনের কাজ এ বছর এক দিনও পৌঁছয়নি গাড়রায়।
উপ-প্রধান বিমলার বক্তব্য, “আমাদের গ্রাম ও আশপাশে কোনও কাজ হচ্ছে না। বার বার বলছি, কেউ শুনছে না। পঞ্চায়েতের প্রধান আমাকে পাত্তা দিচ্ছেন না। অফিস স্টাফেরা আমার কথা শুনছেন না। অথচ গ্রামের মানুষ আমার উপরে ক্ষুব্ধ। বিরক্ত হয়ে মাসখানেক পঞ্চায়েত অফিসে যাচ্ছি না।” তাঁর প্রশ্ন, “এর পরেও আমাকে বলতে হবে, জঙ্গলমহল হাসছে?”
কাঁটাপাহাড়ির পঞ্চায়েত প্রধান সোমবারি হেমব্রম অবশ্য বলেন, “বিমলা কেন পঞ্চায়েত অফিসে আসা ছেড়ে দিলেন, সেটা উনিই বলতে পারবেন। তবে কাজ আস্তে আস্তে হবে। টেন্ডার ডাকা হয়েছে।” গ্রামবাসীরা কিন্তু জানাচ্ছেন, তাঁরা এই ‘হচ্ছে, হবে’ শুনছেন এক বছর ধরে।
মানুষের হাল, গ্রামের ভোল কিছুই পাল্টায়নি যেখানে, সেই গাড়রা, শালডিহাই কিন্তু এক সময়ে পরিচিত ছিল মাওবাদীদের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে। অনেক ক্ষেত্রেই এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যেতে হলে জঙ্গল পেরোতে হয় এখানে। ২০০৯-এর মার্চে মাওবাদী এরিয়া কম্যান্ডার সাওতা ওরফে সুমন মাইতি সঙ্গে থাকায় গাড়রায় প্রবেশের অনুমতি মিলেছিল। তার পরেও দুই যুবক সাওতাকে প্রশ্ন করেছিলেন, “ইনি যে সত্যিই সাংবাদিক, সেটা দেখে নিয়েছ তো?” এমনই দুর্লঙ্ঘ্য ছিল গ্রাম।
অথচ সেই গাড়রার এক জনও জুনিয়র কনস্টেবলের চাকরি কিংবা হোমগার্ড, এনভিএফ বা সিভিক ভলান্টিয়ার-এর কাজ পাননি। দিলীপ সরেন, দুর্গাচরণ মাণ্ডি, মানিক সরেনরা বেকার বসে আছেন। লাগোয়া জঙ্গল থেকে শালপাতা তুলে সেলাই করে বিক্রির মাধ্যমে রোজগার রয়েছে ঠিকই, তবে মাসে আটশো-হাজার টাকার বেশি নয়। আন্দোলন, রক্তপাত, দিনের পর দিন পথ অবরোধ, মিছিলে হাঁটা ও রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরিণতি: শাল পাতা বেচে রোজগার বৃদ্ধি মাসে বড়জোর আড়াইশো টাকা।
‘পরিবর্তন’-এ তা হলে আখেরে কী লাভ হল, গাড়রার মতো একই প্রশ্ন শালবনি এলাকার প্রত্যন্ত গ্রামের হতদরিদ্র প্রৌঢ় বিহারী মাহাতোরও। শালবনিরই একটি ইস্পাত কারখানার শিলান্যাস করে ফেরার পথে ছ’বছর আগে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয় লক্ষ্য করে বিস্ফোরণ ঘটায় মাওবাদীরা। তার পর পুলিশি তল্লাশির জেরেই লালগড়ের দলিলপুর চকে আন্দোলন শুরু। সেই শালবনির ভীমপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের কন্যাবালি গ্রামের বৃদ্ধ বিহারীবাবু বলছেন, “আমি সহায়- সম্বলহীন। বামফ্রন্ট আমলে আমার নাম বিপিএল তালিকায় তোলা হয়নি। পরিবর্তনের পর সাড়ে তিন বছর কেটে গেল। এরাও তুলল না।”
ভীমপুরেরই পাথরপাড়া গ্রামের শম্ভু মাহাতোর বক্তব্য, “এ বছর ১০০ দিনের কাজের মাত্র ১৪ দিন কাজ পেয়েছি। কিন্তু অনেকে এখনই ৬০ দিন কাজ পেয়েছে। কাজ না করেও অনেকে টাকা পাচ্ছে। আর আমি কাজ চাইলে বলা হচ্ছে, উপর থেকে নাম আসেনি। আমি পার্টি করি না। সেটাই কি আমার দোষ?” পাশে দাঁড়ানো ধানঘরি গ্রামের মদন সিংহ বললেন, “এ সব খোলাখুলি বলছ, রাতে যদি তোমাকে উরা তুলে নিয়ে যায় তো কী হবেক?” কিন্তু প্রবীণ শম্ভুবাবু অটল, “যা সত্যি সেটাই বলব। তাতে যা হয়, হবে।” গাড়রা গ্রামের বেকার যুবক সাগেন সরেনেরও সাফ কথা, “আমি তৃণমূলই করতাম। কিন্তু এখন আর ওদের দিকে নেই। এই ক’দিনেই ওদের কাজ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছি।”
তবে এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি ঘাবড়েছেন সুবোধ সহিস। পুরুলিয়ার আড়শার চাটুহাঁসা গ্রাম পঞ্চায়েতের মুদালি গ্রামে সুবোধের নামে ইন্দিরা আবাস প্রকল্পে ঘর মঞ্জুর করা হয়েছিল। ওই প্রকল্পে তিন দফায় মোট ৭৫ হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু এক বছর আগে প্রথম দফার ১৮ হাজার ৭৫০ টাকা আসার পর আর এক পয়সাও আসেনি। কেন, তা জানতে পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে গিয়ে সুবোধকে শুনতে হয়, “পার্টির ছেলেরা তোমাকে কিছু বলেনি? সেইমতো কাজ করো।” দিনমজুরের কাজ করে পেট চালানো সুবোধ জানান, তৃণমূলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা আট হাজার টাকা তাঁর কাছে দাবি করেছিলেন। সুবোধের বক্তব্য, “এখনই আট হাজার টাকা দিয়ে দিলে আমি ঘর তুলব কী করে? আগে পুরো টাকা আসুক, ঘর তৈরি হওরার পর যা টাকা বাঁচবে, সবটাই ওদের দেব বলে জানিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে ওরা রাজি হল না।” সুবোধের প্রাপ্য টাকাও এল না। জীর্ণ কুটিরে এক আকাশ ঝুঁকি মাথায় করে দিন গুজরান করছেন তিনি আর তাঁর পরিবার।
চাটুহাঁসা গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান শিবনাথ টুডু বলেন, “উনি (সুবোধ) নিশ্চয়ই বলেননি যে, আমি টাকা চেয়েছি! ওর কাছে কারা টাকা দাবি করেছিল, সেটা আমাকে খোলাখুলি বললেই পারতেন।”
জেলার তৃণমূল যুবনেতা সুদীপ মাহাতোর খেদোক্তি, “সিপিএম ঠিক এই রকমই জুলুম করেছিল। তাই, মাওবাদীরা যখন ওদের নেতাদের খুন করেছে, গ্রামবাসীদের একাংশ সমর্থন দিয়েছেন। একই ভাবে আমাদের নেতাদেরও কেউ কেউ মাওবাদীদের ফেরার পথ করে দিচ্ছেন!”
মুদালি থেকে কিলোমিটার তিনেক দূরত্বের হেরোডি গ্রামেই কিন্তু অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে মিলেছে মাওবাদীদের গুচ্ছ গুচ্ছ প্রচারপত্র। যাতে আছে হাল আমলের দুর্নীতি নিয়ে চোখা চোখা অভিযোগ।
(চলবে)