সিবিআইয়ের তলব পেয়ে তড়িঘড়ি কলকাতায় ফিরলেন প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদার। বৃহস্পতিবার তাঁর পদ্মপুকুর রোডের ফ্ল্যাটে সুদীপ্ত ভৌমিকের তোলা ছবি।
বৃহস্পতিবার সকাল দশটা। নিজাম প্যালেসের চত্বর থেকে বেরোতে শুরু করল একের পর এক গাড়ি। প্রতিটিতে সওয়ার চার-পাঁচ জন সিবিআই অফিসার।
নিজাম প্যালেসের বিশাল ফটক পেরিয়ে এজেসি বসু রোডে পড়ে কোনওটা ঘুরে গেল ডাইনে। কোনওটা বাঁয়ে। কোনও গাড়ি গিয়ে থামল প্রায় লাগোয়া পদ্মপুকুর রোডে, রাজ্য পুলিশের এক প্রাক্তন ডিজি’র ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে। কোনওটা ছুটল বাগুইআটির দিকে, যেখানে থাকেন সারদা-কর্তার পরিজন। কোনও কোনও গাড়ি আবার খাস কলকাতা শহরের সীমানা ছাড়িয়ে পাড়ি দিল বারাসত-বারুইপুর-বালি-চুঁচুড়ায়।
শহর-শহরতলির বাইশটি জায়গায় এক সঙ্গে অভিযান চালাতে গিয়ে সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়ে গেল। তল্লাশি-জিজ্ঞাসাবাদ তখনও থামল না।
এ দিন সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদারকে ফোন করেন সিবিআই গোয়েন্দারা। রজতবাবু তাঁদের জানান, তিনি বোলপুরে আছেন। তাঁকে দু’ঘণ্টা সময় দিয়ে কলকাতায় ফিরতে বলা হয়। তিনি এসে পৌঁছনোর আগেই অবশ্য সকাল সাড়ে দশটায় তাঁর পদ্মপুকুরের ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে যায় সিবিআইয়ের পাঁচ সদস্যের দল। এই ফ্ল্যাটটিতে রজতবাবু থাকেন না। কিন্তু সিবিআই সূত্রে বলা হচ্ছে, এখানেই সারদার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ সংক্রান্ত নথিপত্র রয়েছে বলে তাদের কাছে খবর। সেই কারণেই ওই ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
রজতবাবু এসে পৌঁছন বেলা আড়াইটে নাগাদ। তত ক্ষণ তাঁর ফ্ল্যাটের সামনে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিলেন সিবিআই অফিসারেরা। রজতবাবু আসার পরে তালা খুলে তাঁরা ভিতরে ঢোকেন। চলে জিজ্ঞাসাবাদ। সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ সিবিআই তল্লাশি সেরে বেরিয়ে যায়। সিবিআই সূত্রের খবর: রজতবাবুর ফ্ল্যাট থেকে কিছু নথি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। রজতবাবুর কথায়, “সারদার সঙ্গে কী ভাবে জড়িত ছিলাম, সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। জানিয়েছি, ২০১১-র জুন থেকে ২০১২-র জুলাই পর্যন্ত সারদার উপদেষ্টা ছিলাম। চুক্তির কাগজ, ব্যাঙ্কের নথি, আয়কর রিটার্ন সিবিআই-কে দিয়েছি।” মার্কিন মুলুকে প্রবাসী বাঙালিদের এক অনুষ্ঠান ঘিরেও সারদা-রজতবাবু যোগাযোগের খবর রয়েছে। “সে বিষয়েও সিবিআইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। জমা দিয়েছি ওই অনুষ্ঠানের সিডি-ও।” জানাচ্ছেন প্রাক্তন পুলিশকর্তা।
ভরদুপুরে রজতবাবুর বাড়িতে যখন সিবিআইয়ের একটা দল অপেক্ষা করছিল, তত ক্ষণে আর একটি দল পৌঁছে গিয়েছিল দমদমের পূর্ব সিঁথিতে, ইস্টবেঙ্গল-কর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতুর বাড়িতে। বেলা সাড়ে তিনটে পর্যন্ত সেখানে তল্লাশি চলে। দেবব্রতবাবু পরে বলেন, “ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য-সহ নানা নথি ওঁদের দিয়েছি। সব রকম ভাবে সাহায্য করেছি।” প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে ব্যবসায়ী রমেশ গাঁধীর অফিসেও তল্লাশি চলেছে। সেখান থেকেও কিছু কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
এই সব ‘প্রভাবশালী’র পাশাপাশি সারদার কিছু কর্মী এবং সংস্থার সঙ্গে অন্য সূত্রে জড়িত কয়েক জনের বাড়িতেও সিবিআই এ দিন হানা দিয়েছে। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর হাতে সারদা-কাণ্ডের তদন্তভার ন্যস্ত করার সময়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছে, এই কেলেঙ্কারিতে টাকা পাচার ও বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের দিকটাও তদন্ত করে দেখতে হবে। তারই প্রেক্ষিতে ওঁদের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে বলে ব্যুরো-সূত্রের দাবি। ওঁরা কারা?
সিবিআইয়ের খবর: ওঁদের মধ্যে রয়েছেন মিতালি বন্দ্যোপাধ্যায় ও পৌলমী মুখোপাধ্যায় নামে সারদার দুই মহিলা কর্মী। অভিযান চলেছে সারদা সংস্থার প্রাক্তন জেনারেল ম্যানেজার নরেশ ভালোটিয়া ও জমি-কারবারের ‘আমিন’ অশোক বিশ্বাসের বাড়িতে। সেই সঙ্গে সারদার বারুইপুরের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার অরিন্দম দাস-সহ একাধিক কর্মীর বাড়িতে হানা দিয়েছে সিবিআই-দল। সারদার অডিটর ও জেনাইটিস কর্ণধার শান্তনু ঘোষের বাড়িতেও তল্লাশি হয়েছে।
অন্য দিকে সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী পিয়ালি সেনের বাগুইআটির বাড়িও এ দিন সিবিআইয়ের-অভিযানের আওতায় ছিল। গিয়েছিল পাঁচ জনের সিবিআই টিম। ঘণ্টা চারেক সেখানে তল্লাশি চলে। পিয়ালি পরে জানান, তদন্তকারীরা তাঁদের কোনও রকম বিরক্ত না করেই তল্লাশি চালিয়েছেন। এমনকী সঙ্গে আনা লুচি-তরকারি-মিষ্টি দিয়ে খাওয়াও সেরেছেন নিজেদের মতো করে। তিনি তদন্তকারীদের চা-বিস্কুট খাওয়ান। তাঁদের প্রশ্নের জবাবও দেন। কিছু জিনিসপত্র কেনার বিল তদন্তকারীরা নিয়ে গিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পিয়ালি। উল্লেখ্য, পিয়ালি একদা সারদা গোষ্ঠীতে ডিরেক্টর পদে ছিলেন। পরে পদ ছেড়ে দেন।
রাতে সিবিআইয়ের এক মুখপাত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জায়গায় জায়গায় তল্লাশি তখনও চলছে।