আগেও বহু আবেদন এসেছে তাঁর কাছে। কখনও গৌতম দেবের উত্তর ২৪ পরগনা সিপিএম থেকে, কখনও শ্যামল চক্রবর্তীর সিটু বা বাম শরিক দলের কোনও সংগঠনের কাছ থেকে। তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই বরাদ্দ ছিল একই রকম শীতল উপেক্ষা। এমনকী, দাবিপত্র হাতে মহাকরণে পৌঁছে যাওয়া বাম প্রতিনিধিদলের সঙ্গেও দেখা করতে চাননি তিনি। যার জেরে কোনও আমলা বা মন্ত্রীর হাতে কাগজ দিয়ে ক্ষোভে মহাকরণ ছাড়তে হয়েছে সাক্ষাৎ প্রার্থীদের।
লোকসভা ভোটের পরেই কিন্তু এই চেনা অবস্থানটা হঠাৎই বদলে ফেলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্প্রতি ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার আবেদন জানান বাম প্রতিনিধিরা। তাতে সম্মতি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৯ জুন নবান্নে বিমান বসুর নেতৃত্বে ১২ সদস্যের বামফ্রন্ট প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ ঘটবে তাঁর সঙ্গে।
কিন্তু হঠাৎ কী এমন ঘটল যে অবস্থান বদলে ফেললেন মমতা? অনেকেই এর জন্য সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটের ফলের দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন। বলছেন, এই ভোটে এক দিকে যেমন মমতার দল বিপুল সাফল্য পেয়েছে রাজ্যে, অন্য দিকে বামেরা প্রান্তিক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরং নতুন শক্তি হিসেবে উঠে আসার সম্ভাবনা দেখিয়েছে বিজেপি। এই পরিস্থিতিতে মমতা এক দিকে বাম প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন। অন্য দিকে বিজেপির থেকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলেন সব ক্ষেত্রে। নবীন পট্টনায়ক বা জয়ললিতার মতো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সশরীর দেখা করা তো দূর, সৌজন্য দেখিয়ে একটি চিঠিও পাঠাননি তিনি। দিল্লিতে দুর্ঘটনায় মৃত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গোপীনাথ মুন্ডেকে শ্রদ্ধা জানাতে দলের কোনও সাংসদকে যেতে বলেননি। কলকাতায় তপন শিকদারের মরদেহে ফুল দিতেও কাউকে পাঠাননি।
অর্থাৎ, বামেদের প্রতি আপাতদৃষ্টিতে সৌজন্য দেখালেও মমতা প্রকৃতপক্ষে বুঝিয়ে দিলেন, রাজ্য রাজনীতিতে এই মুহূর্তে কাদের কোথায় অবস্থান।
মমতার দলেরই কেউ কেউ জানাচ্ছেন, দলনেত্রীর রাজনৈতিক দর্শনই হল, প্রধান প্রতিপক্ষের সঙ্গে কোনও রকম সংস্রব না রাখা। যে কারণে বিরোধী থাকাকালীন তিনি শাসক বামেদের বয়কট করেছেন। আবার ক্ষমতায় আসার পরে রাজ্যের নতুন নামকরণের মতো দু’একটি বিষয় বাদ দিলে বিরোধী বামেদের সঙ্গে আলোচনায় দেখিয়েছেন প্রবল অনীহা। এ বার লোকসভা ভোটের পরে কিন্তু প্রতিপক্ষ হিসেবে তাঁর অগ্রাধিকারটা পাল্টে ফেলেছেন মমতা।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, বামেরা কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে যাবেন রাজ্যে নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাসের অভিযোগ নিয়ে, যেখানে কাঠগড়ায় মূলত তাঁরই দল। এই ব্যাপারে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের ঘোষিত বক্তব্য, বামেরা জনভিত্তি হারিয়ে এখন সন্ত্রাস নিয়ে হইচই করছে। মুখ্যমন্ত্রীও সৌজন্যবশত তাঁদের সময় দিয়েছেন। তৃণমূলের মহাসচিব এবং পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই কটাক্ষ করেছেন, যারা নিজেদের দল সামলাতেই জেরবার, তারা আবার অন্য বিষয় নিয়ে এত ভাবে কী করে! তবে একান্ত আলোচনায় শাসক দলের প্রথম সারির নেতারা মেনে নিচ্ছেন, দলের ভবিষ্যতের লক্ষ্যে নিঃশব্দে কিছু বদল ঘটে গিয়েছে। তৃণমূলের এক রাজ্য নেতার কথায়, “লোকসভা ভোটের পরে দলের সব স্তরের নেতা-কর্মীদের নিয়ে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে প্রথম বৈঠকেও দলনেত্রী বাম বা কংগ্রেসকে নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি! যতটুকু বলেছিলেন, সবটাই বিজেপি নিয়ে।”
আদর্শ সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে নিয়মিত আদানপ্রদানই দস্তুর। কিন্তু সম্প্রতি কেন্দ্র ও রাজ্য এই দুই জায়গাতেই এই রীতির ঘাটতি দেখা গিয়েছে। এ রাজ্যে বিরোধী দলনেতা হিসেবে সূর্যকান্ত মিশ্র নিয়মিত মুখ্যমন্ত্রীকে নানা বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে চিঠি লিখে দরজা খুলে রাখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রীর দিক থেকে কোনও উত্তর আসেনি, পদক্ষেপ করা হয়নি, অভিযোগ বামেদের।
এখন সেই মুখ্যমন্ত্রীই বামেদের আপ্যায়নে রাজি!
এই সাক্ষাৎ নিয়ে সিপিএমের মধ্যেও কিন্তু দ্বিমত রয়েছে। লোকসভা ভোটের পরে গোটা রাজ্যে তৃণমূলের হাতে যখন বাম কর্মী-সমর্থকেরা আক্রান্ত, তখন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নালিশ জানাতে গেলে ভুল বার্তা যেতে পারে বলে দলেরই একাংশের আশঙ্কা। সিপিএমের এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, “দল বা বামফ্রন্ট এ ভাবে এখন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে কর্মী-সমর্থকেরা ভেবে নিতে পারেন, আমরা বোধহয় আত্মসমর্পণ করে ফেললাম!” তবে দলের রাজ্য নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করেননি কেন্দ্রীয় নেতারা।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর অবশ্য যুক্তি, রাজ্যপালের কাছে বহু বার গিয়েও কাজ হয়নি। তাই এ বার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। বিমানবাবু ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সন্ত্রাস নিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা তাঁরা এ বার সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীকে জানাবেন। ঘটনাচক্রে, জেলায় জেলায় বিরোধীদের উপরে হামলা বন্ধে হস্তক্ষেপ চেয়ে বুধবারই বাম পরিষদীয় প্রতিনিধিদল নিয়ে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের কাছে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু। তাঁর বক্তব্য, “এর পরে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে সবিস্তার সব বলবেন বামফ্রন্ট নেতারা।”
৯ তারিখ সেই বিরল ঘটনারই সাক্ষী হবে পশ্চিমবঙ্গ!