বাম দখলে ব্রিগেড। রবিবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।
ঘড়িতে তখন ১টা। রাজ্য কমিটির এক নেতার মুখ গম্ভীর। পাশে দাঁড়ানো আর এক নেতাকে বললেন, “এ বার ব্রিগেড ভরবে না। এখনও অনেকটাই ফাঁকা!” পাশের নেতা অবশ্য তখনও আশা হারাননি “এখনও উত্তর (২৪ পরগনা) ঢোকেনি। আরও দু’টো মিছিল আসা বাকি। ঠিক ভরে যাবে!”
সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্বও তখন কিছুটা দ্বিধায়। মাইকে রবীন দেব ঘোষণা করছেন, দুপুর ১টার সভা শুরু হবে দেড়টায়। মঞ্চের ফুট বিশেক দূরে দাঁড়িয়ে এক কর্মী তখন আর এক ‘কমরেড’কে বলছেন, “বাঁ-দিকটা এখনও ভরেনি। সে জন্যই একটু দেরি করে সভা শুরু করছে। গত বছর কিন্তু এ সময়ে ব্রিগেড ভরে গিয়েছিল!”
রবীনবাবুদের হিসেবে শেষ পর্যন্ত খুব ভুল হয়নি। কানায় কানায় না হলেও দেড়টার সময়ে ‘উত্তরের’ মিছিল ঢোকার পরে ব্রিগেড অনেকটাই ভরল। আর মাঠ ভরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জনতার হাততালি যেন সভার সুর অনেকটাই বেঁধে দিল।
নেতারা অবশ্য জানাচ্ছেন, গত বছর ৯ ফেব্রুয়ারির ব্রিগেডে আরও বেশি লোক এসেছিল। সারদা কেলেঙ্কারির জেরে লোকসভা ভোটে শাসক দল তৃণমূল ধাক্কা খাবে, এই আশা তখন বাম মহলে প্রবল। ভিড় জমেছিল সেই প্রত্যাশা নিয়েই। কিন্তু তা পূরণ হয়নি। উল্টে লোকসভা ভোট-সহ পরের পর উপনির্বাচনে বামেদের ভোটবাক্সে ভাঙন অব্যাহত থেকেছে।
ব্রিগেড ভরাতে এসে কাঁটাতার টপকে ভিক্টোরিয়ায়। নিজস্ব চিত্র
বারবার ব্রিগেডে ভিড় হয় অথচ ভোটে কোনও ছাপ পড়ে না এই দৃশ্যের পুনরাবৃ্ৃত্তি দেখে দেখেই সম্ভবত নেতারা এ বার ভিড় নিয়ে কিছুটা সাবধানী।
যে প্রসঙ্গে অনেকে বলছেন, রবিবারের ভিড়টাকে সাংগঠনিক অবস্থা বোঝার মাপকাঠি হিসেবেই দেখতে চাইছিলেন তাঁরা। চাইছিলেন সমালোচকদের জবাব দিতেও। রাজ্য কমিটির এক সদস্যের কথায়, “আমাদের সংগঠন ভাঙছে, বিজেপি বাড়ছে। কিন্তু এই ভাঙার পরেও আমাদের সংগঠন তো বিজেপির চেয়ে এগিয়ে! এ বার যে ভিড়টা এসেছে, সেটা কিন্তু ওই সংগঠন কাজে লাগিয়েই।” একই সুরে সীতারাম ইয়েচুরি এবং মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য যাঁরা বলছিলেন লাল পতাকা বলে কিছু নেই, তাঁদের ‘জবাব দিয়েছে’ এই জমায়েত!
সভার শুরুতে সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট বলেছিলেন, “লাল ঝান্ডে কো কভি কোই ঝুকা নেহি সকতা”। সঙ্গে সঙ্গে বিপুল হাততালি আর স্লোগান। সেই সুর বজায় রইল মোটামুটি সব নেতার বক্তব্যে। যাঁদের মধ্যে ঝাঁঝালো, মেঠো বক্তৃতা দিয়ে সবচেয়ে বেশি হাততালি কুড়িয়ে নিয়ে গেলেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিম। যিনি বললেন, “লড়াই ময়দানে হবে। চিট ফান্ডের টাকায় নয়! জান কবুল, মান কবুল। কর্মী বাহিনীর মধ্যে থেকেই আমরা লড়ব।” উত্তেজিত জনতা তখন আছড়ে পড়ছে সামনে বাঁশের ব্যারিকেডে। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানের সঙ্গে জনতাকে যুক্ত করে প্রায় নরেন্দ্র মোদীর কায়দায় বক্তৃতা শেষ করলেন রাজ্য থেকে লোকসভায় সিপিএমের দুই সাংসদের অন্যতম সেলিম।
দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নীলোৎপল বসুর কথায়, “গত বছরের ব্রিগেডে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেক বেশি ঘোলাটে ছিল। এ বার তা অনেক বেশি স্পষ্ট। তাই দিশা দেখাতেও অসুবিধা হয়নি।” শাসক দলের হাতে জেলার কর্মীরা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁদের পাশে দাঁড়াননি বলে অভিযোগ উঠেছে এতদিন। এ বার কর্মীদের চাঙ্গা করতে নেতারাই এগিয়ে এসে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।
শুধু তা-ই নয়, বারবার কর্মীকুলকে গুরুত্ব দিয়ে তাঁদের শিকড়ের সঙ্গে নিজেদের জুড়ে নেওয়ার মরিয়া চেষ্টাও চালিয়েছেন সিপিএম নেতৃত্ব। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, “আপনারা আছেন বলেই আমরা আছি। তাই আপনাদের লাল সেলাম জানাচ্ছি।”
নেতাদের দাবি, এই গুরুত্বকে পাল্টা মর্যাদা দিয়েছেন কর্মীরাও। বহু বাধা-বিপত্তি সামলে তাঁরা এ দিনের সভায় এসেছেন। অভিযোগ, তৃণমূল কলকাঠি নাড়ায় এ বারও অনেক জায়গাতেই সিপিএম কর্মীরা বাস পাননি। এমনকী বহু জায়গায় লঞ্চ পরিষেবাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া, ব্রিগেডে আসার পথে বাস আটকানো এবং ব্রিগেড-ফেরত বাসে হামলার অভিযোগও উঠেছে।
গড়িয়া থেকে এসেছিলেন সন্দীপ দাস। সঙ্গে শ’পাঁচেক কর্মী। কী ভাবে এলেন? সন্দীপবাবুর জবাব, “বাস মালিক কথা দিয়েও বাস দিলেন না। বাধ্য হয়ে মেট্রোয় এলাম।” সোনারপুর লোকাল কমিটির সদস্য শক্তি বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, এক মাস আগে থেকে জানানো সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে বাসমালিকেরা পিছিয়ে গিয়েছেন। ফলে গড়িয়া থেকে অনেকে আসতে পারেননি।
ডোমজুড় লোকাল কমিটির সম্পাদক বিদ্যুৎ সিংহরায়ের দাবি, “অন্য বার বাসে আসতে ১৬০০ টাকা লাগত। এ বার লাগল তিন হাজার!” বাস না পেয়ে ছোট গাড়ি, ম্যাটাডোর ভাড়া করে এসেছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদের শ’পাঁচেক সিপিএম সমর্থক। হাসনাবাদ জোনাল কমিটির সদস্য দাউদ আলি সর্দারের অভিযোগ, “তৃণমূলের চাপে পড়ে বসিরহাট, হাসনাবাদ রুটের মালিকরা বাস দেননি। শিয়ালদহ পর্যন্ত ট্রেনে এসে মিছিলে পা মিলিয়েছি।” একই দাবি হাটগোবিন্দপুর, খড়দহ, ডায়মন্ড হারবার, উত্তরপাড়া, শ্রীরামপুর, গোঘাট, চুঁচুড়া থেকে আসা সিপিএম কর্মীদের।
শুনে এক নেতা বললেন, “২০১০ সাল থেকে এ ভাবেই কর্মীরা ব্রিগেডে আসছেন। এত কষ্ট করে এসেও প্রতি বার শূন্য হাতে ফিরতে হয়। এ বার অন্তত খানিকটা লড়াইয়ের দিশা দেখানো গিয়েছে। দেখা যাক, কী হয়!”
তবে নেতাটি জানলে ভরসা পেতেন, টুকরো টুকরো আশাবাদেরও অনেক ছবি ব্রিগেড জুড়ে। মুর্শিদাবাদের আতাহার শেখ, বাবান মণ্ডল, বারুইপুরের অপর্ণা মণ্ডল কিংবা পুরুলিয়ার ননীগোপাল হাজরাদের বক্তব্য, “ভোট হয়তো কমছে। পার্টি এখন কিছুটা কোণঠাসা। কিন্তু সম্ভাবনা এখনও আছে।” দমদমের দুর্গা দে, ব্যারাকপুরের মহামায়া ঘোষ, গুমারের মহম্মদ আলতাফ হোসেন মণ্ডলদের এক রা “কে বলেছে পার্টি শেষ হয়ে গিয়েছে? ৩৪ বছর তো ক্ষমতায় ছিলাম। এখন লড়াইয়ের ময়দানে। এক দিনে সব কিছু পাল্টে যাবে নাকি!”
আলতাফের কথার খেই ধরে মুখ থেকে সোয়াইন ফ্লু আটকানোর ‘মাস্ক’টা খুলে ফেলেন নিরাজুদ্দিন আহমেদ। বলে ওঠেন, “উই শ্যাল ওভারকাম!”