মুখে মধু দিলে নাকি কথা মিষ্টি হয়!
রাজ্য রাজনীতির তুমুল বিতণ্ডা আর প্রবল কুকথার ঢেউ কি মধুতে বাগ মানবে? রাজ্য সরকারের বন উন্নয়ন নিগম কিন্তু এ ব্যাপারে বেশ আশাবাদী। বিধানসভার চলতি বাজেট অধিবেশনেই সব বিধায়ককে মধু দিতে উদ্যোগী হয়েছে নিগম। নিগমের চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ ঘোষের বিশ্বাস, এর ফলে নিগমের মধুর প্রচারও হবে। সেই সঙ্গে বিধানসভায় সতীর্থদের সম্পর্কও মধুর হবে।
মনিয়র উইলিয়ামসের সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধানে মধু মানে মিষ্টি, ভাল, আনন্দদায়ক, খুশি। একের পর এক সংস্কৃত মন্ত্রে মধু মানে সুন্দর ও সুধা। ঋগ্বেদে দ্বিতীয় মণ্ডলে ৪১ নম্বর সূক্তে ইন্দ্রকে সোমরস পানে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে ‘এই সোম তীব্র মধুমান, এই কাম্য সোম পান করে মত্ত হও’ বলে। উপনিষদেও বারবার মধুর উল্লেখ রয়েছে। বৃহদারণ্যকের দ্বিতীয় অধ্যায়, পঞ্চম ব্রাহ্মণের বিখ্যাত মন্ত্র ‘ইদং সত্যং সর্বেষাং ভূতানাং মধু’। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে রয়েছে ‘মধু বাতা ঋতায়তে’-র উল্লেখ। এখানে মধু-র অর্থ আনন্দ।
মহাভারতের স্ত্রী পর্বে বিদুরের বলা একটি কাহিনিতে মধুর অর্থ অবশ্য আরও গভীর। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরে শোকাহত, হতাশ ধৃতরাষ্ট্রকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বিদুরের তাঁকে বলেছিলেন এক ব্যক্তির কাহিনি। ভয়ঙ্কর এক অরণ্যে ঢুকে প্রাণভয়ে ছুটতে ছুটতে লোকটি পড়ে গিয়েছিলেন কুয়োর মধ্যে। হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ অবস্থায় কোনও মতে জংলি লতাপাতা ধরে ঝুলছিলেন। কুয়োর নীচে ফণা তুলে রয়েছে মারাত্মক সাপ। উপরে একটি হাতি, যার ছয় মাথা বারো পা। একটি সাদা ইঁদুর ও একটি কালো ইঁদুর কুড়কুড় করে কাটছে লতাপাতা ও একটি বিরাট গাছের শিকড়। সাক্ষাত্ মৃত্যু শিয়রে। কিন্তু সেই অবস্থাতেই সেই ব্যক্তির মুখে পড়ছিল বিন্দু বিন্দু মধু। তাঁর ঠিক মাথার উপরেই ছিল মৌচাকটি। যতই মধু পান করেন, পিপাসা মেটে না। বরং আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়।
বিদুর বললেন, মহারাজ, এই কূপ জীবনের প্রতীক। আর ওই মধু জীবনের আনন্দ। যে আনন্দের জন্য এই বিপদসঙ্কুল জীবনেও বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা মেটে না।
বাংলার সংস্কৃতিতে মধু মদের জন্যও বিখ্যাত। গুড় দিয়ে তৈরি গৌড়ীয় মদ ছিল সে কালে বিখ্যাত। কিন্তু প্রাচীন বাংলায় মধু দিয়েও মদ তৈরি হত। চর্যাপদেও মধুর উল্লেখ রয়েছে। চার নম্বর চর্যায় রয়েছে, ‘জইনি তই বিনু ক্ষণহি ন জীবহি / তো মুমচুম্বি কমলরস পান করি।’ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ডিন নির্মল দাসের মতে, “এই কমলরস আসলে মধুর সমার্থক।” তবে ২১ নম্বর চর্যায় মুনিদত্তের করা টীকায় দীননাথের যে চারটি লাইন উদ্ধৃত করা হয়েছে, সেখানে কমলমধু শব্দটিই সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে। চৈত্রের অপর নামও মধু মাস।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে মধুর অর্থ পুষ্পরস, সোমরস, সুমিষ্ট রস এবং সুরা। রামায়ণেও মধু-র উল্লেখ অনেকটা সুরার মতোই। সুন্দরকাণ্ডে মধুবন নামে একটি উদ্যানে ঢুকে পড়ে হনুমান, অঙ্গদ-সহ মহাবীর বানরেরা মধু খেয়ে মত্ত হয়ে গিয়েছিলেন। দধীমুখ নামে সেই উদ্যানের রক্ষীর সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধও হয়েছিল। তবে বাঙালির সংস্কৃতিতে মধু-র প্রধান প্রতিষ্ঠা সুমিষ্ট রস ও আনন্দ হিসেবেই।
শাসক ও বিরোধীদের সম্পর্ক মধুর করতে সেই মধুই ব্যবহার করতে চাইছে বন নিগম। নিগম সূত্রের খবর, বিধানসভার সব সদস্যকে ৫০০ গ্রাম করে মধু দেওয়া হবে। নিগম সূত্রে জানা গিয়েছে, বিধানসভার অধ্যক্ষের সম্মতি মিলেছে। ২ জুলাই বিধানসভার কাউন্টারে ওই মধু পৌঁছে দেওয়া হবে। ১০ জুলাই পর্যন্ত নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে বিধায়কেরা ওই মধু সংগ্রহ করতে পারবেন। এই ‘সরকারি মধু’ দিতে প্রায় ৩৩ হাজার টাকা খরচ হবে। বিরোধী দল কংগ্রেস ও সিপিএম অবশ্য এই মধুদান প্রকল্পে তেমন কোনও মাধুর্য দেখতে পাচ্ছে না। সিতাইয়ের কংগ্রেস বিধায়ক কেশব রায়ের দাবি, মধু বিলির নামে অহেতুক নিগমের মোটা টাকা খরচের যুক্তি নেই। রাজ্যের প্রাক্তন বনমন্ত্রী তথা সিপিএমের কোচবিহার জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অনন্ত রায়ের কটাক্ষ, “মধু বিলি করে প্রকৃত অবস্থা আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে।” তবে ফরওয়ার্ড ব্লকের কোচবিহারের জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।
নিগম সূত্রের দাবি, বাম আমলেও বিধানসভায় মধু বিলি করা হতো। ওই জমানার শেষ দিকে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে শুধু বিধায়করাই নন। আম বাঙালি যাতে মধুর স্বাদ সহজে পেতে পারেন, সে জন্য রেশনের মাধ্যমে কম দামে সুন্দরবনের খাঁটি মধু বিক্রির উদ্যোগও অনেকটা এগিয়েছে।
রাজ্য জুড়েই কি তবে মধুবাতাস বইবে? মানুষের কথা মানুষই বলবেন। তবে কংগ্রেস বিধায়ক কেশববাবু স্পষ্ট বলে দিচ্ছেন, “সরকার সম্পর্কে বিরোধীদের মূল্যায়ন এর ফলে মধুর হবে, তা যেন কেউ আশা না করেন।”
হায় মধু!